



















Previous
Next
আম্বেদকর জন্মেছিলেন সতীদাহ আর গৌরীদানের দেশে৷ অথচ দলিত হিসেবে তাঁর প্রান্তিক অবস্থানই হয়ত নারীর প্রান্তিকতার প্রতি সমমর্মী করেছিল। ভারতের নারী আন্দোলনে তিনি ত্রাতার ভূমিকায় নয়, অবতীর্ণ হন কর্মীর ভূমিকায়। ডঃ আম্বেদকর নারী আন্দোলনে প্রথম বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন ১৯২৮ সালের ২২শে অক্টোবর মহারাষ্ট্রে ‘নারী মর্যাদা সুরক্ষা’ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার মধ্যে দিয়ে। তাঁর ডাকে সেদিন বম্বে শহরে হাজার হাজার নারী সমবেত হয়। সমাজের সব স্তরের, সব বর্ণের নারীরা এই আন্দোলনে সাড়া দেন। এই আন্দোলনের মূল অ্যাজেন্ডা ছিল-
১) নারীর আত্মমর্যাদা রক্ষা ২) নারী সুরক্ষা ৩) নারী শিক্ষা ৪) ধর্মীয় ও সামাজিক সমানাধিকার।
এরপর ডঃ আম্বেদকর নাসিকে ‘নারীর মন্দিরে প্রবেশের অধিকার’ সংক্রান্ত আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। নারীদের মন্দিরে প্রবেশের অনধিকারের চূড়ান্ত প্রতিবাদ করে ১৯৩০ সালের ২-রা মার্চ, রবিবার, ৩০ হাজার মানুষের একটি বিশাল মিছিল নাসিকের মন্দিরের দিকে সুশৃঙ্খল ভাবে এগোতে থাকে। পুলিশের বাধা ও নির্যাতন সহ্য করে রাত ১১-টায় মন্দিরে প্রবেশ করে তিনি দৃপ্ত কন্ঠে বলেন -‘এই দ্যাখো, নারীর স্পর্শে মন্দির অপবিত্র হয়ে যাচ্ছে না। দেবতারাও মন্দির ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে না ‘(ইন্ডিয়ান ডেইলি মেল পত্রিকা ৫/৩/১৯৩০)। আজও যখন শবরীমালা আন্দোলন হয়, তখন তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করেই হয়।
১৯৪২ সাল থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত পরাধীন ভারতের শ্রমমন্ত্রী থাকার সময় নারী শ্রমিকদের জন্য তিনি একাধিক কর্মসূচী গ্রহণ ও রূপায়ণ করেন।
যেমন- ১) নারীর সম কাজে সম বেতন। আগে কর্মক্ষেত্রে পুরুষদের তুলনায় নারীদের প্রায় অর্ধেক বেতন দেওয়া হত। আম্বেদকর তা রদ করেন।
২) চাকুরিরতা মহিলা কর্মীদের মাতৃত্বকালীন ছুটি চালু করা। আজও আমরা এই ন্যায্য ছুটি ভোগ করি। ৩) মহিলাদের জন্য উপযুক্ত স্বাস্থ্যকর আবাসন তৈরির আইন। ৪) নারীদের ‘এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ’-এর মাধ্যমে চাকুরিতে নিয়োগ। ৫) পুরুষদের পাশাপাশি নারী শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার ও ভোটে দাঁড়ানোর অধিকারে আইন প্রণয়ন। এই সব অবদান গুলি ভারতবর্ষের বুকে তিনিই সর্ব প্রথম চালু করেন এবং আইনে পরিণত করেন।
স্বাধীন ভারতের আইনমন্ত্রী হিসেবে ১৯৪৮ সালে তিনি পার্লামেন্টে পেশ করেন তাঁর ‘হিন্দু কোড বিল’। বিলটিতে ছিল ৯ টি পার্ট এবং আর্টিকেলের সংখ্যা ছিল ১৩৯ টি। উল্লেখযোগ্য প্রস্তাবগুলি ছিল
১) পিতার সম্পত্তিতে মেয়েদের সমান অধিকার।
২) সমস্ত ধর্মীয় ও সামাজিক ক্ষেত্রে মহিলাদের সমান অধিকার। ৩) মৃত স্বামীর সম্পত্তিতে স্ত্রীর পূর্ণ অধিকার।
৪) কোন নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে বিয়ে দেওয়া দণ্ডনীয় অপরাধ।
৫) হিন্দু বিবাহ আইন চালু করা।
৬)বিবাহবিচ্ছেদ আইন চালুর করা ও সেখানে সম্পত্তিতে স্ত্রী-র উত্তরাধিকার ও ভরণপোষণ-এর উল্লেখ।
দুঃখের বিষয় হলো, সেদিন পিতৃতান্ত্রিক পার্লামেন্টে বিলটি পাশ হয়নি। আম্বেদকর আইন মন্ত্রীর পদ ত্যাগ করেন এর পর।
ডঃ আম্বেদকর যখন ভারতের সংবিধান রচনার দায়িত্বভার পান, তখনও নারীদের প্রতি তাঁর কর্তব্যনিষ্ঠা, স্বহৃদয়তা, সহানুভূতি, মানবিকতার বিস্ময়কর অবদানের পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর তৈরি সংবিধানের নানা ধারায়।। সংবিধানের ১৫ক, ১৬ক, ১৭, ১৯, ২৩, ২৯, ৪৬, ১৬৪, ৩৩০, ৩৩২, ৩৩৪, ৩৩৫, ৩৩৮, ৩৩৯ক ইত্যাদি ধারায় সমাজের দুর্বলতর শ্রেণি (তফসিলি জাতি-উপজাতি) ও সমগ্র নারী জাতির অধিকারের কথা তিনি দৃঢ়ভাবে লিপিবদ্ধ করেন। এই ধারাগুলিতে যা বলা হয়েছে তা বাবাসাহেবের নারীভাবনার নির্যাস।
তিনি চেয়েছিলেন ও সংবিধানে লিখেছিলেন, রাষ্ট্র নারীদের সমানাধিকার দেবে। নাগরিকদের মধ্যে কোনরূপ লিঙ্গবৈষম্য থাকবে না। মন্দির, রেস্তোরাঁ, বিনোদন স্থান, দোকান সর্বত্রই নারীদের সমান প্রবেশাধিকার থাকবে। রাষ্ট্রের অধীনে চাকুরিতে নারীকে সমান সুযোগ দিতে হবে। লিখেছিলেন, নারীর অর্থনৈতিক উন্নয়নকে রাষ্ট্র যথেষ্ট গুরুত্ব দেবে। তাদের সবরকম শোষণ ও অন্যায় থেকে রাষ্ট্র রক্ষা করবে। আঠারোর নিচে মেয়েকে বিয়ে দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য হবে। নারী শিক্ষার জন্য রাষ্ট্র স্বতন্ত্র কমিশন গঠন করবে। আলাদা বিদ্যালয়, কলেজ গঠন, মহিলা শিক্ষিকা নিয়োগ, আবাসিক শিক্ষা ব্যবস্থা, ছাত্রী নিবাস, বিদ্যালয়ে যাতায়াতের ব্যবস্থা, বিনামূল্যে টিফিন, বৃত্তিমূলক শিক্ষার সুযোগ, বিনামূল্যে বই দেওয়া ইত্যাদিতে রাষ্ট্র বাধ্য থাকবে।
ভারতের পিতৃতান্ত্রিক ব্রাহ্মণ্যবাদের সামনে বাবাসাহেব চিরকালই ছিলেন এক দৃপ্ত বিরুদ্ধ স্বর।
‘বামা’ বাবাসাহেবের মুক্তচিন্তার আকর থেকে কিছু মণিমুক্তো তুলে আনল। তাঁর উক্তিগুলি তাঁর চিন্তা-ভাবনা ও আদর্শ সম্পর্কে যেন বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন করায়৷
Nice idea