বাংলায় ভোট-মাস। আর ভোট-মাস মাসে বিশ্বদর্শন। প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রকট হলেই তো ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর যত অন্ধকার, যত দাঁত নখ, তাও প্রকট হয়। প্রকট হয় সার্বিক হিংস্রতা, উগ্রতা। আর লিঙ্গসাম্য নিয়ে যাঁরা চর্চা করি, তাঁরা অবাক হয়ে দেখি, কীভাবে প্রতিনিয়ত উদগ্র হচ্ছে কুরুচিকর বডিশেমিং ও নারীবিদ্বেষ৷ এই দুইটি প্রান্তর কোনো পার্টির একচেটিয়া নয়। আজ যিনি ভিক্টিম, কাল তিনিও প্রতিপক্ষকে একই ভাষায় আক্রমণ করতে পারেন। ভাষা তথা ভঙ্গির গুরুত্ব বড় কম নয় ক্ষমতার রাজনীতিতে। তারা ঘৃণা ও নৃশংসতার বাহন হয়ে ওঠে এ সময়।
পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষিতে আমরা দেখেছি মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং বডিশেমিং-এ কম যান না৷ কখনও মোটাভাই, কখনও হোঁদলকুতকুত বলে আক্রমণ করেন প্রতিপক্ষকে, যাকে মেঠো ভাষা বলে উড়িয়ে দেন অনেকে৷ কিন্তু প্রশ্ন জাগে, পুরুষের বডিশেমিংকেও যদি স্বাভাবিকত্ব দেওয়া হয়, তাহলে নারীর বডিশেমিং আটকানো কি কঠিন হয়ে যাবে না? স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর কি ভাষার প্রতি আরও যত্নশীল হওয়া উচিত নয়? তিনি নিজেও তো কম আক্রান্ত নন। আমরা দেখেছি, প্রচারকালে তাঁর গোড়ালির উপর থেকে শাড়ি উঠেছে কি ওঠেনি, বিপক্ষ দলের সভাপতি অশ্লীল আক্রমণ করছেন মুখ্যমন্ত্রীকে। এ আক্রমণ নতুন নয়। মহিলা রাজনীতিককে তাঁর পোশাক -আশাক, চলন-বলনকে তথা চরিত্র তুলে আক্রমণ আমরা ২০১৯ সালের নির্বাচনেও দেখেছি। দেখেছি আতিশি মারলেনা বা জয়া প্রদার বেশ্যায়ন। নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুরের সময় বেশ্যায়ন হয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও। আবার তিনিই ক্ষমতায় এসে সাধারণ নাগরিক মানবী ধর্ষিতা হলে তাকে বলেছেন ‘সাজানো ঘটনা’। ভারতীয় সংসদের কোন কক্ষেই আজও মহিলাদের জন্য ৩৩% আসন সংরক্ষণ সম্ভব হয়নি৷ মহিলারা প্রার্থী হলেও অনেকেই পুরুষদের হাতের ক্রীড়নক হিসেবেই কাজ করেন। ধর্ষক কুলদীপ সিং বহিষ্কৃত হলেও যেমন টিকিট দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয় তাঁর স্ত্রী কে। এ হেন পিতৃতান্ত্রিক বাতাবরণে রাস্তায় বেরোনো, বেপর্দা চলাচল, চাকরি করা থেকে শুরু করে রাজনীতি করা- সবেতেই মেয়েদের পথকে কণ্টকিত করার প্রধানতম উপায় হল, তাদের পোশাক-আশাক চলন বলনের জিগির তুলে তার চরিত্রহনন করা।
লিঙ্গসাম্যের কর্মীরা এসব ঐতিহ্যের সঙ্গে কম বেশি পরিচিত তাই৷ আবার একথাও সত্য যে, বর্তমানে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে যে শক্তিটি আত্মপ্রকাশ করেছে, তাদের নিয়ে তাঁরা কিঞ্চিৎ বেশি উদ্বেগে ভুগছেন৷ এই দলটি যেহেতু স্বভাবত ফ্যাসিবাদী, ও ফ্যাসিবাদ যেহেতু স্বভাবতই নারীবিরোধী, তাই উৎকণ্ঠার কারণ আছে যথেষ্ট৷ সাধারণ নাগরিকের অবশ্যই অধিকার আছে নতুন বিকল্পকে সুযোগ দেওয়ার। কিন্তু সেই বিকল্প কি এমন কেউ হতে পারে যে আট বছরের মেয়েকে দিনের পর দিন মন্দিরে আটকে রেখে যৌন নির্যাতন করে হত্যা করে শুধুমাত্র এই কারণে যে সে যাযাবর মুসলমান, তার গুষ্টিকে ভয় দেখিয়ে খেদানো দরকার? সেই বিকল্প কি হতে পারে এমন কেউ যে ধর্ষকদের সমর্থনে মিছিল করে জাতীয় পতাকা নিয়ে? এমনটাই তো ঘটেছে কাঠুয়াতে৷ সে বিকল্প কি এমন কেউ যে ধর্ষিতার গোটা পরিবারকে হত্যা করে? উন্নাওতে সে নজিরও আমরা দেখেছি৷ সে বিকল্প কি এমন কেউ যে পুলিশকে নির্দেশ দেয় যাতে ধর্ষিতা দলিত মেয়ের দেহ জ্বালিয়ে দেওয়া হয় রাতারাতি?
যে দলটি রাজ্যে প্রধান বিরোধী হিসেবে ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে, যে দলটি কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন, আমরা যেন ভুলে না যাই, তারা মনুবাদী ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতান্ত্রিক আদর্শের ধারক বাহক৷ তাই নারী ও তৃতীয় লিঙ্গের প্রতি তাদের হীন দৃষ্টিভঙ্গি পূর্বনির্দিষ্ট৷ আরএসএস-এর প্রধান এম এস গোলওয়ালকর ১৯৬০ সালে গুজরাট ইউনিভার্সিটিতে ছাত্রদের উদ্দেশে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন,
“যে কোনও বর্ণের বিবাহিত মহিলার প্রথম সন্তান অবশ্যই নাম্বুদিরি ব্রাহ্মণ দ্বারা জন্মগ্রহণ করা উচিত এবং তারপরে তিনি তার স্বামী দ্বারা সন্তানের জন্ম দিতে পারেন।”
অর্থাৎ আপনি যদি মহিলা হন আর কোনো সন্তানের মা হতে চান তবে আপনার সঙ্গীর বদলে নাম্বুদিরি ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের কোনো পুরুষের সঙ্গে আপনাকে যৌনতা করতে হবে যতদিন পর্যন্ত না আপনি গর্ভবতী হচ্ছেন। কারণ তাহলেই আপনার গর্ভ শুদ্ধ হবে। সেই পুরুষের ঔরসজাত সন্তান আপনার গর্ভে আসার পর দ্বিতীয় সন্তান আপনি আপনার স্বামীর সঙ্গে শারীরিক মিলনের মাধ্যমে নিতেই পারেন। আরএসএস-এর বর্তমান প্রধান মোহন ভাগবত তো বলেছেনই,
“ছেলেরা বিবাহ করে সুখ পাওয়ার জন্যে, আর মেয়েরা বিয়ে করে ছেলেদের সুখ দেওয়ার বিনিময়ে নিজেদের পেট চালানোর জন্য…মেয়েদের বাড়ির মধ্যেই থাকা উচিত ও বাড়ির কাজই করা উচিত।”
মনুশাস্ত্রে নারী পুরুষের ইচ্ছাধীন এক সম্ভোগ, সেবা ও সন্তান উৎপাদনের এক ত্রিমুখী যন্ত্র। সাক্ষী মহারাজ থেকে সাধ্বী প্রজ্ঞা সবাই বলেন হিন্দু নারীকে অন্তত চার-পাঁচটি সন্তান উৎপন্ন করতে হবে মুসলমানদের ঠেকাতে। মোহন ভাগবত বলেন ধর্ষণ হল বিদেশি সংস্কৃতি ও নারী-স্বাধীনতার ফল। কৈলাস বিজয়বর্গীয় বলেন, ধর্ষণ ঠেকাতে নারীকে ‘লক্ষ্মণরেখা’-র মধ্যে থাকতে হবে। আদিত্যনাথ বলেন, ‘মেয়েদের রক্ষা করতে হবে, তাদের স্বাধীনতা দেওয়া অবান্তর। পুরুষই তাকে রক্ষা করবে। শৈশবে পিতা, যৌবনে স্বামী আর বার্ধক্যে পুত্র তাকে রক্ষা করবে।’
তাই নারী কাকে বিয়ে করবে বা কার সঙ্গে থাকবে, তা নিয়ে যখন এই দলের শাসিত রাজ্যগুলিতে আইন-অর্ডিন্যান্স চালু হয়, আমরা অবাক হই না। কিন্তু ভয় পাই। লাভ জিহাদ অর্ডিন্যান্স তো শুধু সাম্প্রদায়িক নয়, তা নারীর স্বাধীন সিদ্ধান্তের ধারণার বিরুদ্ধে। রাষ্ট্র নারীর জীবনে সঙ্গী নির্বাচনের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারে কি? আজ মুসলমানকে বিয়ে করায় মানা হয়েছে। কাল অসবর্ণে বিয়ে না করার আইন আসবে। আমরা কি পিছন দিকে হাঁটছি? শুধু সঙ্গী নির্বাচন কেন, বারবার নারীর পোষাকের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হচ্ছে। মোহন ভাগবত বলছেন নারীর পোষাকে কুরুচিকর পশ্চিমী প্রভাবের কথা, স্বামী নিশ্চলানন্দ সরস্বতী তো আরও স্পষ্ট করেই বললেন, জিন্স পরলে ধর্ষণ হয়! আর খাবার? নারী হয়ে দেবলীনা কেন বললেন তিনি গোমাংস রান্না করতে পারেন। ব্যাস, তাঁকে গণধর্ষণ করার নিদান আসতে লাগল। এই দল ক্ষমতায় এলে নারীর খাওয়া দাওয়া, পোষাক, জীবিকা, জীবন যাপন, পছন্দের সঙ্গী নির্বাচন -কিছুরই অধিকার থাকবে কি? নারী-আন্দোলনের অস্তিত্ব থাকবে কি? আমাদের এই ছোট পত্রিকাটিও কি আর থাকবে?
ভোটমাস তাই উদ্বেগ আর আশঙ্কারও। এমতাবস্থায় সাধারণ নাগরিকের পক্ষে প্রতিরোধই একমাত্র পথ। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার বোধ নিয়েও, বামা তাই প্রতিরোধেই অবিচল থাকল৷ অস্থির সময়ে প্রকাশ পেল বামা-র প্রথম বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা। পড়তে থাকুন বামা।
এই প্রথম বামার সম্পাদকীয় পড়ছি। এই প্রথম পত্রিকাটির সাথেও পরিচয়। লিঙ্গ রাজনীতির একই চেহারা দেশে দেশে। ভালো লাগলো।