হেলেন কেলারের How I Became a Socialist প্রবন্ধের অনুবাদ
হেলেন অ্যাডামস কেলার (২৭শে জুন, ১৮৮০ – ১লা জুন, ১৯৬৮) মাত্র ১৯ মাস বয়সে অসুস্থতার ফলে বাক-শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি হারান। আট বছর বয়সে অ্যানি সুলিভান নামের এক গৃহ-শিক্ষিকা তাঁর পড়াশোনার দায়িত্ব নেন। তাঁদের ৪৯ বছরের সম্পর্ক এইভাবে শুরু হয়। অ্যানি নিজেও একজন দৃষ্টি-প্রতিবন্ধি ছিলেন। অ্যানি প্রথমে আঙুল দিয়ে হেলেনের হাতে বিভিন্ন চিহ্ন এঁকে এবং তারপর বর্ণমালা কার্ড দিয়ে তাঁকে বর্ণমালা শেখান। তারপর হেলেন ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়াশোনা করেন। এই মিস সুলিভানই বিবাহোত্তর জীবনে মিসেস মেসি নামে পরিচিত হন, যাঁর উল্লেখ অনুদিত প্রবন্ধে আছে।
প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও হেলেন চব্বিশ বছর বয়সে স্নাতক হন। তিনি ছিলেন বিশ্বের প্রথম দৃষ্টিশক্তি-শ্রবণশক্তিহীন স্নাতক। তিনি পরবর্তীকালে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি হয়ে উঠেছিলেন আমেরিকার একজন গুরুত্বপূর্ণ লেখক ও সামাজিক-রাজনৈতিক কর্মী।
বাক-শ্রবণ ও দৃষ্টি-প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে তিনি সচেষ্ট হন। জীবদ্দশায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টদের তথা আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল, মার্ক টোয়েন, চার্লি চ্যাপলিনের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিদের প্রশংসা অর্জন করেন। তাঁর রচিত বইয়ের সংখ্যা ১২ টি। প্রধান বই হচ্ছে দ্য স্টোরি অফ মাই লাইফ (১৯০৩), লেট আস হ্যাভ ফেইথ, দ্য ওয়ার্ল্ড আই লিভ ইন (১৯০৮), ওপেন ডোর ইত্যাদি। রাজনৈতিক জীবনে তিনি ছিলেন আমেরিকান সোশ্যালিস্ট পার্টির সমর্থক। হেলেন ১৯০৯ সালে এই দলে যোগদান করেন। ধনতান্ত্রিক অসাম্যের শেষ দেখতে চাইতেন তিনি। ১৯১২ সালে তিনি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স অব দ্য ওয়ার্ল্ডে যোগদান করেন। হেলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার যোগদানের বিরুদ্ধে ছিলেন। আলোচ্য প্রবন্ধটি তিনি লিখেছিলেন নিজের সমাজতান্ত্রিক অবস্থান ব্যাখ্যা করতে। একদিকে যেমন এই প্রবন্ধ সমাজতন্ত্রীদের দ্বারা প্রশংসিত হয়েছিল, তেমনই অন্যদিকে জার্মানীতে নাজিরা এই প্রবন্ধ পুড়িয়ে দিয়েছিল।
বেশ কয়েক মাস ধরে আমার নাম ও সমাজতন্ত্র শব্দ দুটি প্রায়শই একসঙ্গে খবরের কাগজে প্রকাশিত হচ্ছে। এক বন্ধু বলেছিল আমার নাম খবরের কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় বেসবল, মিঃ রুজভেল্ট এবং নিউইয়র্ক পুলিশ কেলেঙ্কারির সঙ্গে দেখা যেত। এই বিষয়গুলির সঙ্গ আমাকে তেমন সুখী করেনি। তবে সামগ্রিকভাবে আমি আনন্দিত যে অনেক লোক আমার এবং আমার শিক্ষক, মিসেস মেসি (অ্যান সুলিভান)-র সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হয়েছেন। এমনকি অপযশকেও কাজে লাগানো যায় এবং আমার ক্রিয়াকলাপ নথিবদ্ধ করার জন্য সংবাদপত্রগুলি যদি তাদের কলামগুলিতে প্রায়শই সমাজতন্ত্র শব্দটি ব্যবহার করতে বাধ্য হয়, তাহলে আমি আনন্দিত। ভবিষ্যতে আমি সমাজতন্ত্র সম্পর্কে লিখতে চাই। আমার মতামত প্রচার করতে চাই। এখন পর্যন্ত আমি বিষয়টি নিয়ে খুব কমই লিখেছি এবং বলেছি। কয়েকটা চিঠি লিখেছি, বিশেষত কমরেড ওয়ারেনকে একটি চিঠি লিখেছিলাম, যা ‘আপিল টু রিজেন’-এ ছাপা হয়েছিল। আমি কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গেও কথা বলেছি, যার মধ্যে ‘নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড’-এর মিঃ আয়ারল্যান্ড একটি বিশ্বস্ত প্রতিবেদন তৈরি করেছেন এবং আমি যা বলেছিলাম তা পুরোপুরি সুষ্ঠুভাবে উপস্থাপন করেছেন। আমি কখনই স্কেনেকটাডিতে যাইনি। আমি কখনই মেয়র লুনের সাথে দেখা করিনি। তাঁর কাছ থেকে আমি কখনও কোনও চিঠি পাইনি, তবে তিনি মিঃ মেসির মাধ্যমে আমাকে সদয় বার্তা প্রেরণ করেছেন। মিসেস মেসির অসুস্থতার কারণে স্কেনেকটাডির কর্মীদের সঙ্গে আমার যোগদানের যে পরিকল্পনা ছিল, তা পরিত্যাগ করতে হয়েছে।
এ জাতীয় নেতিবাচক এবং তুলনামূলকভাবে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে পুঁজিবাদী প্রেসে এবং এমনকি সমাজতান্ত্রিক সংবাদমাধ্যমে অনেক সম্পাদকীয় রচিত হয়েছে। তার ক্লিপিংস-এ একটি ড্রয়ার ভর্তি হয়ে গেছে। আমি তাদের এক-চতুর্থাংশও পড়িনি, এবং মনে হয় না যে আমি কখনই সেগুলি পড়ব। যদি এত সামান্য ঘটনা এত মন্তব্য আমন্ত্রণ করে থাকে, তাহলে আমি যদি সমাজতন্ত্রের পক্ষে আন্তরিকভাবে লিখতে এবং বলতে শুরু করি, তবে সংবাদপত্রগুলি কী করবে? এখন আমার উচিত আমার অবস্থান সম্পর্কে একটি বিবৃতি দেওয়া, কিছু ভ্রান্ত প্রতিবেদন সংশোধন করা এবং কিছু অন্যায় সমালোচনার জবাব দেওয়া।
প্রথমত, আমি কিভাবে সমাজবাদী হয়ে উঠলাম? বই পড়ে। প্রথম যে বইটি পড়েছিলাম তা হ’ল ওয়েলসের ‘নিউ ওয়ার্ল্ড ফর ওল্ড’। আমি মিসেস মেসির সুপারিশে এটি পড়েছিলাম। তিনি এই বইটির কল্পনাশক্তির দ্বারা আকৃষ্ট হয়েছিলেন ও আশা করেছিলেন যে এর বৈদ্যুতিন শৈলী আমাকে উৎসাহিত এবং আগ্রহী করবে। যখন তিনি আমাকে বইটি দিয়েছিলেন, তখনও তিনি সমাজবাদী ছিলেন না, এখনও সমাজবাদী নন। মিঃ মেসি ও আমার সঙ্গে আলোচনা আর তর্ক করতে করতে তিনি হয়ত একদিন তা হয়ে উঠবেন।
আমার পাঠ সীমিত এবং ধীর। আমি দৃষ্টিহীনদের জন্য ব্রেইলে রচিত জার্মান দ্বিমাসিক ‘সমাজতান্ত্রিক সাময়িকী’ নিই। (আমাদের জার্মান কমরেডরা অনেক দিক থেকে আমাদের চেয়ে এগিয়ে।) আমি জার্মান ব্রেইল-এ কাউটস্কির এরফুর্ট প্রোগ্রামের আলোচনা পড়েছি। আমি যে অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক সাহিত্য পড়েছি তা আমার হাতে বানান করে পড়তে সাহায্য করেছেন এক বান্ধবী, যিনি সপ্তাহে তিনবার এসে আমি যা পড়তে পছন্দ করি তা পড়তে সাহায্য করেন। আমি প্রায়শই তার প্রাণবন্ত আঙুলগুলিকে অনুরোধ করেছি ‘ন্যাশনাল সোশালিস্ট’ নামক সাময়িকী থেকে পড়ে দিতে। তিনি শিরোনাম সম্পর্কে আমাকে প্রথমে অবহিত করেন এবং আমি কোনটা পড়ব আর কোনটা বাদ দেব তা তাঁকে বলি। তিনি ‘ইন্টারন্যাশনাল সোশালিস্ট রিভিউ’-এর নিবন্ধগুলি এভাবে পড়তে সাহায্য করেছেন। অর্থনীতি সম্পর্কে ৫০,০০০ শব্দের একটি বই আঙ্গুলের মাধ্যমে পাঠোদ্ধার করা কোনও সহজ এবং দ্রুত কাজ নয়। তবে এটি এক আনন্দযাত্রা, ক্লাসিক সব সমাজতান্ত্রিক লেখকের সঙ্গে নিজেকে পরিচিত না করা পর্যন্ত আমি এই আনন্দ বার বার উপভোগ করব।
পূর্বোক্ত কথার আলোকে আমি আমার সম্পর্কে একটি টুকরো মন্তব্যের দিকে আলোকপাত করতে চাই, যা ছাপা হয়েছিল ‘কমন কজ’-এ, আর ‘লাইভ ইস্যু’-তে পুনরায় ছাপা হয়েছিল। দুটিই সমাজবাদ-বিরোধী কাগজ। এখানে সেই লেখা থেকে একটি উদ্ধৃতি দেওয়া হল:
“পঁচিশ বছর ধরে মিস কেলারের শিক্ষক এবং অবিচ্ছিন্ন সহচর ছিলেন মিসেস জন মেসি, যিনি পূর্বে থাকতেন ম্যাসের ভেরেন্টাম-এ। মিঃ মেসি এবং মিসেস মেসি উভয়ই উৎসাহী মার্কসবাদী প্রচারক এবং এঁদের উপর নিজের একান্ত জ্ঞানের জন্য আজীবন নির্ভরশীল মিস কেলার যে সেরকম জ্ঞানই পাবেন, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।”
মিঃ মেসি হয়ত একজন উৎসাহী মার্কসবাদী প্রচারক হলেও হতে পারেন, যদিও আমি দুঃখের সঙ্গে জানাই যে তিনি আমার ক্ষেত্রে আঙ্গুল দিয়ে আমাকে পাঠ দান করে মার্কসবাদ প্রচারে তেমন উৎসাহ দেখাননি। মিসেস মেসি মার্কসবাদী নন, সমাজবাদীও না। সুতরাং ‘কমন কজ’ তাঁর সম্পর্কে যা বলেছে তা সত্য নয়। সম্পাদক অবশ্যই এই সব গালগল্প উদ্ভাবন করেছেন। যদি তাঁর মন এইভাবে ক্রিয়াশীল থাকে, তবে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে তিনি সমাজতন্ত্রের বিরোধী। সমাজতান্ত্রিক হওয়া বা বুদ্ধিগতভাবে সার্থক যে কোনও কিছু হওয়ার জন্য যা দরকার, সেরকম যথেষ্ট জ্ঞান তাঁর নেই।
একই নিবন্ধ থেকে আরেকটি উদ্ধৃতি বিবেচনা করুন। শিরোনামটি এরকম:
“স্কেনেকটাডিতে-তে লাল-দের প্রচার; অন্ধ নারী হেলেন কেলার-কে প্রচার অর্জনের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে।”
তারপরে নিবন্ধটি শুরু হবে:
“স্কেনেকটাডিতে সমাজবাদীদের দ্বারা বেচারা হেলেন কেলারের বর্তমানে যে শোষণ ঘটছে, তার চেয়ে বেশি করুণ আর কিছু কল্পনাও করা কঠিন। দলের প্রকাশনা সংস্থাগুলি কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রচার করছে যে তিনি সমাজতান্ত্রিক। তিনি স্কেনেকটাডিতে জনকল্যাণ বোর্ড-এর নতুন সদস্য হতে চলেছেন।”
“বেচারা হেলেন কেলারের শোষণ” এই উক্তিটি নিয়ে আমি ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য করতেই পারতাম। তবে আমি তা না করে শুধু বলব যে, ‘কমন কজ’ জাতীয় কাগজের ভণ্ডামি-পূর্ণ সহানুভূতি আমি পছন্দ করি না। তবে “শোষণ” শব্দের অর্থ এদের কাছে ঠিক কী, তা যদি জানতে পারতাম, ভালো লাগত।
আসুন, সত্যটা কী, তা দেখা যাক। মেয়র লুন যখন শুনলেন যে আমি স্কেনেকটাডিতে যেতে পারি, তখন তিনি জনকল্যাণ বোর্ডকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে আমার জন্য একটি স্থান রাখা উচিত। ‘দ্য সিটিজেন’, মেয়র লুনের কাগজ, এ সম্পর্কে কিছুই ছাপেনি। প্রকৃতপক্ষে, বোর্ডের উদ্দেশ্য ছিল আমি স্কেনেকটাডিতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে মুখ না খোলা। তবে পুঁজিবাদী সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিকরা এই পরিকল্পনার খবর পেয়ে গেলেন এবং একদিন, মেয়র লুনের স্কেনেকটাডিতে অনুপস্থিতির সময়, আলবানির নিকারবকার প্রেস খবরটি ঘোষণা করে দিল। সারা দেশে টেলিগ্রাফ করা হল। তারপরেই শুরু হয়েছিল সত্যিকারের ‘সংবাদপত্রের শোষণ’। সমাজতান্ত্রিক প্রেস দ্বারা? না, পুঁজিবাদী প্রেস দ্বারা। সমাজতান্ত্রিক কাগজগুলি সংবাদটি ছেপেছিল এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ আমাকে স্বাগত জানিয়ে সম্পাদকীয়ও লিখেছিল। কিন্তু ‘সিটিজেন’, মেয়র লুনের কাগজটি, সেই সব সপ্তাহেও নীরবতা রক্ষা করেছিল, আমার নামও উল্লেখ করেনি, যেখানে অন্য সাংবাদিকরা টেলিফোন এবং টেলিগ্রাফ করে সাক্ষাৎকারের জন্য আমাকে উত্যক্ত করে চলেছিল। তার মানে, বরং পুঁজিবাদী প্রেসই রীতিমতো অত্যাচার শুরু করেছিল। কেন? এই সাধারণ সংবাদপত্রগুলি কি সমাজতন্ত্র নিয়ে আগ্রহী? না, অবশ্যই না। তারা সমাজতন্ত্রকে ঘৃণা করে। তবে হায়! আমি নিজে খবরের কাগজের গালগল্পের বিষয়। আমরা যে স্কেনেকটাডিতে আছি, এই মিথ্যা অস্বীকার করে করে এতটাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম যে, যে প্রতিবেদক প্রথম এই ‘সংবাদ’ প্রকাশ করেছিলেন আমি তাকে ঘৃণা করতে শুরু করি।
এটা সত্য যে, পুঁজিবাদী কাগজ আমাকে সমাজবাদী বলে অভিহিত করার পরে সমাজতান্ত্রিক কাগজগুলিও আমাকে নিয়ে লিখেছে। তবে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসা সমস্ত সাংবাদিক সাধারণ বাণিজ্যিক পত্রিকা থেকেই এসেছিলেন। কোনো সমাজবাদী কাগজ, ‘কল’ বা ‘ন্যাশনাল সোশালিস্ট’, কেউই আমাকে কখনো নিবন্ধ দিতে বলেনি। ‘দ্য সিটিজেন’-এর সম্পাদক মিঃ মেসিকে এক ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে আমার নিবন্ধ পেলে তাঁর ভালো লাগবে। তবে তিনি সরাসরিই তা বলেছিলেন।
‘নিউইয়র্ক টাইমস’ আমার থেকে একটি নিবন্ধ চেয়েছিল। ‘টাইমস’-এর সম্পাদক আমাকে আশ্বাস দিয়ে লিখেছিলেন যে তাঁর কাগজটি জনসাধারণের কাছে পৌঁছানোর জন্য এক মূল্যবান মাধ্যম। এই বলে তিনি আমার কাছে একটি নিবন্ধ চেয়েছিলেন। তিনি আমাকে আমার পরিকল্পনাগুলির একটি বর্ণনা পাঠাতে বলেছিলেন এবং শেনেকটাডির জনকল্যাণ বোর্ডের সদস্য হিসাবে আমার দায়িত্ব সম্পর্কে একটি রূপরেখা চেয়েও টেলিগ্রাফ করেছিলেন। আমি আনন্দিত যে আমি সেই অনুরোধ রাখিনি। কারণ কিছু দিন পরে ‘টাইমস’ আমাকে তার মহান সহানুভূতি থেকে দূরে সরিয়ে, আমাকে সামাজিকভাবে বহিরাগত ঘোষণা করেছিল। ২১ শে সেপ্টেম্বর ‘টাইমস’-এ একটি লেখা প্রকাশিত হয় “দ্য কমটেম্পটিবল রেড ফ্ল্যাগ” নামে। আমি এর থেকে দুটি অংশ উদ্ধৃত করছি:
“পতাকাটি স্বাধীন। তবে পতাকাটি কুরুচিপূর্ণ। এটি বিশ্বজুড়ে আইন-শৃঙ্খলা ভঙ্গের ও নৈরাজ্যের প্রতীক। তাই বিশ্বজুড়ে সব সুস্থমস্তিষ্কের লোকই এটির অবমাননা করে।”
“লাল পতাকার ধারককে পুলিশ ততক্ষণ নিগ্রহ না করতেই পারে যতক্ষণ না সে এমন কোনো অন্যায় কাজ করে, যাকে লাল পতাকাটি ‘ন্যায়সঙ্গত’ বলে। তবে তাকে সর্বদা সন্দেহের চোখে দেখা উচিত। যে ব্যক্তি অনাচারের প্রতীক বহন করে, তার শ্রদ্ধা ও সহানুভূতির সমস্ত অধিকার না দাবি করাই উচিত।”
আমি কোনও রঙের কাপড়েরই উপাসক নই। তবে আমি লাল পতাকা ভালবাসি, আমার কাছে তথা অন্যান্য সমাজবাদীদের কাছে এই পতাকা যে সমস্ত ধারণার প্রতীক সেই সব ধারণাকে আমি ভালবাসি। আমার পড়ার ঘরে একটি লাল পতাকা ঝুলছে। আমি খুশি হতাম যদি এই পতাকা নিয়ে ‘টাইমস’-এর অফিসের সামনে দিয়ে যেতে পারতাম এবং সমস্ত সাংবাদিক এবং ফটোগ্রাফারদের জন্য দর্শনীয় মুহূর্ত তৈরি করতে পারতাম। ‘টাইমস’-এর নিন্দা অনুসারে, আমি শ্রদ্ধা ও সহানুভূতির সমস্ত অধিকার হারিয়েছি, এবং আমাকে সন্দেহের চোখে দেখা উচিত। তবুও ‘টাইমস’-এর সম্পাদক চান যে আমি তাকে একটি নিবন্ধ দিই! আমি সন্দেহজনক চরিত্র হলে কিভাবে তাঁর পক্ষে আমাকে বিশ্বাস করা সম্ভব? একজন পুঁজিবাদী সম্পাদক যখন বড়লোকি স্বার্থে আঘাত-হানা আন্দোলনের নিন্দা করার চেষ্টা করেন, তখন তিনি যে সব খারাপ নীতি, খারাপ যুক্তি, খারাপ আচরণের দৃষ্টান্ত রাখেন, তা আমার মতো আপনাদেরও আমোদ দেবে, আশা রাখি। আমরা সহানুভূতির অধিকারী নই, তবুও আমরা কেউ কেউ এমন নিবন্ধ লিখতে পারি, যা তাঁর কাগজকে অর্থোপার্জনে সহায়তা করবে। সম্ভবত আমাদের মতামতের তার কাছে সেই ধরনেরই মূল্য, যা তিনি একজন বিখ্যাত খুনির স্বীকারোক্তিতে খুঁজে পাবেন। আমরা ভালো না, তবে আমরা আকর্ষণীয়।
আমি সাংবাদিকদের পছন্দ করি। আমি তাঁদের অনেককেই চিনি এবং তাঁদের দু-তিনজন আমার সবচেয়ে অন্তরঙ্গ বন্ধুদের অন্যতম ছিলেন। তদুপরি, আমরা অন্ধদের জন্য যে কাজটি করার চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম সেগুলিতে সংবাদপত্রগুলি খুবই সাহায্য করেছে। অন্ধদের জন্য কাজে বা কিছু আপাত দাতব্যে সাহায্য করলে আদৌ কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হয় না তাদের। কিন্তু সমাজতন্ত্র- আহ্, সে এক অন্য বিষয়! তা সমস্ত দারিদ্র্য এবং দাতব্যর মর্মমূলে প্রবেশ করে যে! সংবাদপত্রের পেছনে যে অর্থশক্তি, তার জোগানদাতারা সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে। তাই সম্পাদকরা- যাঁরা তাঁদের অন্নদাতাদের অনুগত- তাঁরা সমাজতন্ত্রকে লঘু করতে এবং সমাজবাদীদের প্রভাবকে হ্রাস করতে যত দূর পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব, ততদূরই যাবেন।
কমরেড ফ্রেড ওয়ারেনের প্রতি লেখা আমার চিঠিটি যখন ‘আপিল টু রিজন’-এ প্রকাশিত হয়েছিল, তখন আমার এক বন্ধু, যিনি ‘বস্টন ট্রান্সক্রিপ্ট’-এর একটি বিশেষ বিভাগ দেখেন, তিনি আমার লেখাটি সম্পর্কে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। প্রধান-সম্পাদক সেটি ছাপেননি।
আমার ও সমাজতন্ত্রের সম্পর্কে ‘ব্রুকলিন ঈগল’ বলেছে, হেলেন কেলারের “ভুলগুলি তার বিকাশের সীমাবদ্ধতা থেকে উদ্ভুত।” কয়েক বছর আগে আমার সঙ্গে একজন ভদ্রলোকের পরিচয় হয়েছিল, যাঁকে ‘ব্রুকলিন ঈগল’-এর সম্পাদক মিঃ ম্যাককেলওয়ে হিসাবে চিনেছিলাম। অন্ধদের জন্য নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত একটি বৈঠকের পরে আমাদের সেই সাক্ষাৎ হয়েছিল। সেই সময়ে তিনি আমার যে প্রশংসা করেছিলেন, তা এতটাই উদার ছিল যে আমি তা স্মরণ করতেও লজ্জা পাচ্ছি। তবে এখন যেহেতু আমি সমাজতন্ত্রের হয়ে বক্তব্য রেখেছি, সেহেতু তিনি আমাকে এবং জনসাধারণকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে আমি অন্ধ এবং বধির, আর তাই বিশেষত আমার ভুল হতেই পারে। তাঁর সাথে দেখা হওয়ার পরের বছরগুলিতে নির্ঘাৎ আমার বুদ্ধি সঙ্কুচিত হয়েছে। এবার নিশ্চয় তাঁর লজ্জা পাওয়ার পালা। নিশ্চয় একমাত্র বধিরতা ও অন্ধত্বই সমাজতন্ত্রের দিকে ঝুঁকতে পারে। মার্কস সম্ভবত সম্পূর্ণ বধির ছিলেন এবং উইলিয়াম মরিস অন্ধ ছিলেন। মরিস তার ছবিগুলি স্পর্শ দিয়ে এঁকেছিলেন এবং ওয়াল পেপারগুলো গন্ধ শুঁকে বিন্যাস করেছিলেন।
হায়, হাস্যকর ব্রুকলিন ঈগল! এ কেমন মর্যাদাহীন পাখি তুমি! সামাজিকভাবে অন্ধ এবং বধির, যা একটি অসহনীয় ব্যবস্থাকে রক্ষা করে- এমন একটি ব্যবস্থা যা অনেকের শারীরিক অন্ধত্ব এবং বধিরতার কারণ, যাকে আমরা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছি। ‘ঈগল’ আমাদের দুর্দশা রোধ করতে সাহায্য করবে যদি, শুধুমাত্র যদি, সেই শিল্পক্ষেত্রের অত্যাচারের বিরুদ্ধে আমরা মুখ না খুলি, যাকে এটি সমর্থন করে, যা এর চোখ বন্ধ করে রেখেছে। অতএব ঈগল এবং আমরা যুদ্ধে মুখোমুখি। আমি সেই ব্যবস্থাকে ঘৃণা করি যার প্রতিনিধিত্ব এরা করে, যার জন্য এরা যুক্তি সাজায় এবং যাকে এরা সমর্থন করে। কিন্তু সে যখন লড়াই ফিরিয়ে দিচ্ছে, তখন অন্তত সুষ্ঠুভাবে লড়ুক। আমার ধারণাগুলিকে আক্রমণ করুক, সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য এবং তার যুক্তিগুলির বিরোধিতা করুক। আমাকে এবং অন্যদেরকে আমার অন্ধত্ব বা বধিরতা স্মরণ করিয়ে দেওয়া কোনো ন্যায়সঙ্গত লড়াই নয়, ভালো যুক্তি নয়। আমি পড়তে পারি। আমার সংগ্রহে থাকা ইংরাজি, জার্মান এবং ফরাসি ভাষায় সমাজতান্ত্রিক বইগুলি আমি পড়তে পারি। ‘ব্রুকলিন ঈগল’-এর সম্পাদক যদি সেগুলির কয়েকটি পড়েন তবে তিনি বুদ্ধিমান হয়ে উঠতে পারেন, একটি ভালো সংবাদপত্র প্রকাশ করতে পারেন। সোশ্যালিস্ট আন্দোলনে আমার সামান্য অবদান হিসেবে যে বইটি লেখার স্বপ্ন দেখে থাকি, তা যদি কখনও লিখতে পারি, তাহলে আমি জানি বইটির নামটি কী রাখব: শিল্পক্ষেত্রের অন্ধত্ব এবং সামাজিক বধিরতা।