বারে বারে ডাকো কেন সিটি বাজিয়ে,
জেলার বাবু রেখে গেছে তালা লাগিয়ে,
এক ফাইল ভাত দেয় পেট ভরে না,
আসামিরা খেটে খেটে আর পারে না,
উকিল আমার মামা শ্বশুর, হাকিম আমার শালা,
ছেড়ে দাও গো জেলার, জেলে বড় জ্বালা।
—– মেদিনীপুর জেলের গান
সকাল ১১টা নাগাদ মেদিনীপুর জেল গেটে সম্পদ এসেছে দেখা করার জন্য নাম লেখাতে। টেবিলের ওপার থেকে প্রশ্ন এলো, ‘বধূ না মাওবাদী’। সম্পদ চকিতে বুঝতে পেরে বলে ‘মাওবাদী’। ‘২ টোয় আসবেন’ শুনে সম্পদ মুচকি হেসে চলে যায়।
২০১০ সালে দেড় মাসের মতো ছিলাম মেদিনীপুর জেলে। ধরেছিল শালবনীর রামেশ্বরপুর থেকে। অভিযোগ ছিল একটি ডিজিটাল ক্যামেরা, একটি ভয়েস রেকর্ডার, ক’টা পেন, একটি নোটবই আর ৫,০০০ টাকা দিয়ে রাষ্ট্রদ্রোহ, দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ইত্যাদি ষড়যন্ত্র করা। ধরার আগে বুঝতে পারিনি সাংবাদিক ও লেখক বন্ধুদের সাথে যৌথ- বাহিনীর দখলে জঙ্গলমহলের অবস্থা দেখতে যাওয়াটাও অপরাধ। সাংবাদিকদের ছেড়ে দিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে এফ-আই-আর হলো। অবশেষে ঠাঁই হল মেদিনীপুর জেলে। লালগড় আন্দোলনে শয়ে শয়ে জঙ্গলমহলের মানুষকে জেলযাত্রা করিয়েছিল সেই সময়ের বাম সরকার। আজ যদিও সরকার বাম থেকে তৃণমূল হয়েছে কিন্তু সেই সময়কার পঞ্চাশেরও বেশি আন্দোলনকারী আজ দশ বছর পরেও বাংলার বিভিন্ন জেলে বন্দী।
মেদিনীপুর জেল ভারতের প্রাচীনতম জেলগুলির মধ্যে একটি। প্রায় তিরিশ একর জমি নিয়ে তৈরি। প্রেসিডেন্সি বাদে কেবলমাত্র মেদিনীপুর জেলে ফাঁসিকাঠ আছে কিন্তু শুনলাম যে মেদিনীপুরেরটা নাকি ১৯৪৭ সালের পর থেকে অকেজো। এই জেলে প্রখ্যাত বিপ্লবী প্রদ্যুত ভট্টাচার্য়, কৃষ্ণচন্দ্র চৌধুরী, হরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, কৃষ্ণকিশোর চক্রবর্তী ও নির্মলজীবন ঘোষকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। জেলের বয়স প্রায় দেড়শ বছর। তেরোটি ওয়ার্ড ও বত্রিশটি সেল নিয়ে পুরুষ জেল। দোতলা সেল ওয়ার্ড। নয়টি কনভিক্ট (সাজাপ্রাপ্তের) আর চারটি আন্ডারট্রায়াল (বিচারাধীনদের) ওয়ার্ড ছাড়িয়ে ডান দিকে উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা একটি ওয়ার্ডে মহিলা জেল অথবা সংশোধনাগার। পাশে ব্যবহার-অযোগ্য প্রাচীন ওয়ার্ডের ধবংসাবশেষও রয়েছে। মেদিনীপুর মহিলা জেল পুরোদস্তুর জেল নয়। এটি ট্রানজিট জেল। রাখা হয় বিচারাধীন বন্দীদের যাদের মামলা মেদিনীপুরের কোর্টে চলছে। মহিলা জেলে রান্নার ব্যবস্থা নেই। চা, জলখাবার, দুপুর ও রাতের খাবার পুরুষ ওয়ার্ডের রান্নাঘর থেকে আসতো। রান্নাঘর বিহীন এক কৃত্রিম পরিবেশে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর মেয়েদের থাকতে হয় মেদিনীপুর জেলে, যেখানে তাদের রোজকার জীবনের কোনো কর্মকান্ড নেই। পশ্চিমবঙ্গে পুরোদস্তুর মহিলা জেল আছে দুটি- পুরুলিয়ায় ও কোলকাতায়।
মেদিনীপুর মহিলা জেলের একটি মাত্র ব্যারাকে চল্লিশজনের থাকার ব্যাবস্থা ছিল কিন্তু সব সময়ে ভরে থাকতো পঞ্চাশেরও বেশি। কোনো কোনো সময়ে এই সংখ্যা ষাটও ছাড়িয়ে যেতো। তার মধ্যে চুরি ছিনতাইয়ের কেস নেই বললেই চলে, মার্ডার আঙ্গুলে গোনা যায়। অর্ধেকেরও বেশি বন্দী ছিল বধূ হত্যার কেসে। বধূও আবার দু রকম – ‘হাফ’ আর ‘ফুল’। ‘হাফ মার্ডার’ হচ্ছে হেনস্তার কেস (ধারা 498A, IPC), আর ‘ফুল মার্ডার’ হলো সরাসরি প্রাণনাশের কেসে বন্দী। লালগড় আন্দোলনের জন্য প্রচুর আন্দোলনকারীও বন্দী ছিল। তারা সবাই জেলের জন্য ‘মাওবাদী’। তাই ‘বধূ না মাওবাদী’।
আদালতের নির্দেশ ছিল ১৪ দিনের জেল হেফাজত (যা পরে পাঁচবার বেড়ে হয় মোট দেড় মাস)। তাই এসে পড়লাম মেদিনীপুর জেল গেটে। গেটের ফর্মালিটি সেরে নিয়ে আসা হল মহিলা জেলের দরজায়। মহিলা জেলে ঢোকার রাস্তা ওয়ার্ডেনের ঘর কিংবা অফিস দিয়ে। ওয়ার্ডেনের ঘর ভেতর ও বাইরে থেকে তালা মারা। চাবি থাকে গেটে অবস্থিত অফিস ঘরে। এ যেন মেয়ে বন্দীদের সাথে ওয়ার্ডনরাও বন্দী। যে জেলকর্মী আমায় নিয়ে এলেন তাঁর হাতে ছিল একগুচ্ছ চাবি। তিনি একজন আসামী এনেছেন জানিয়ে বাইরের তালা খুলে একটা ছোটো জানালা দিয়ে চাবির গোছা এগিয়ে দিলেন ওয়ার্ডেনকে। ভেতরের তালা খুলে ওয়ার্ডেন আমায় নিয়ে নিলেন। ওয়ার্ডেনের ঘর/ অফিস বেশ ছোটো। আসবাবপত্র বলতে একটা ছোট খাট, একটা চেয়ার, ছোট টেবিল আর স্টীলের আলমারি। তা দিয়েই ঘর ভরে গেছে। আফিস ঘরের বাইরে দড়ি ঝোলানো আছে, যেটা টানলে ভেতরে বিকট শব্দ হয় আর তখনই সবাই জেনে যায় নতুন আমদানি এলো। মহিলা জেল পুরুষ জেলের ভিতরে, তাই এই ব্যবস্থা। ডাক পড়লো সন্ধ্যার। সন্ধ্যার সাথে আরও অনেকে এসে দাঁড়ালো। সন্ধ্যাই হলো আমার প্রথম সাক্ষাৎ, কারাবাসের প্রথম চরিত্র। তাই সন্ধ্যাকে দিয়েই শুরু করছি।
সন্ধ্যা, বয়স ৫০, বেশ রোগা, ছোটোখাটো, ঝাঁঝালো গলা। সন্ধ্যা বললো – দাঁড়াও, সার্চ হবে। পুরুষ লেডিজ টেলারের মতো সন্ধ্যা মনের আনন্দে সার্চের নামে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে শরীর মেপে ফেললো। ব্যাগ সার্চের নামে জামাগুলি তুলে যা হাসাহাসি করলো তাতে আমার খুব কান্না পেলো। প্রথম আলাপেই অপছন্দ। ট্রানজিট জেল যদিও বিচারাধীন বন্দীদের জন্য, আর যেহেতু তাদের দিয়ে কোনো কাজ করানো যায় না কারণ তাদের সাজা হয়নি, তাই ক’জন সাজাপ্রাপ্তদের জেলে রাখতে হতো এবং তাদের যোগ্যতা অনুসারে কাজ দেওয়া হতো। সন্ধ্যা ছিল এইরকম একজন ‘মেট’। সন্ধ্যার কাজ ওয়ার্ডের দেখাশোনা করা। নতুন বন্দী এলে তার খাওয়ার বাসন, কম্বল, ফাইল (বসার জায়গা) ঠিক করা, স্যানিটারি প্যাড বিতরণ করা, ইত্যাদি আর বন্দী চলে গেলে সবকিছু গুছিয়ে রাখা। কোনো সময়ে স্যানিটারি প্যাডের ঘাটতি হলে দেখতে হয় সন্ধ্যার কেতা। সন্ধ্যার বাড়ি কাঁথির দিকে ছিল। অপরাধ ছিল নাতনি হত্যা – ৪/৫ বছরের শিশুকন্যার হত্যা। দশ বছর কারাবাসের মধ্যে ছয় বছর কেটে গেছে। ওয়ার্ডের একটা কোণ তার দখলে। সেখানে লাইন দিয়ে রাখা ছিল তার পোটলা-পুটলি। সবাই তাকে এড়িয়ে চলতো। তার সম্পদের দিকে তাকালে গালি দিয়ে ভূত ভাগিয়ে দিত। সময়ের সাথে বেড়েছে পুজোপাঠ। সকালে উঠে দালান ঝাঁট দিয়ে স্নান সেরে পুজো করতো বেশ কিছুটা সময় ধরে। জেলে পুজোর বড় বাহার। জেল কর্তৃপক্ষও খুব উৎসাহিত করতো পুজোর ব্যাপারে। ব্যারাকের লম্বা দিকের দুটি দেওয়ালে মোটা মোটা লোহার রড দিয়ে পাঁচটি করে ছাদ থেকে মেঝে অবধি জানালা। এক দিকের পুরো দেওয়াল আর অপর দিকে লোহার রডের বড় দরজা বাদে বাকি দেওয়াল ক্যালেন্ডার কেটে ঠাকুরের ছবি দিয়ে ভরা। সন্ধ্যা বড় দেওয়ালের ঠাকুরদের আগে পুজো দিয়ে ছোটো দেওয়ালে শেষ করতো। বিকেলে জোর গলায়ে গাইতো কীর্তন। রাতে চলতো টিভি পর্ব। আমার থাকাকালীন দেড় মাসে কেউ সন্ধ্যার সাথে দেখা করতে আসেনি। আপাতদৃষ্টিতে খুব হল্লাবাজ মনে হলেও সন্ধ্যা ছিল খুব চাপা। কোনোদিন বাড়ির কথা বলতে শুনিনি। তবে সন্ধ্যার মতো গালাগালি খুব কম মেয়েই দিতে পারে। কোথায় যেন পড়েছিলাম যে মেয়েদের নিষিদ্ধ গালিগলাজ উচ্চারণ তাদের মুক্ত করে। মেয়েদের এত বেশি বাধ্যবাধকতার মধ্যে থাকতে হয় যে এইরকম ছোটো ছোটো কাজ, যেমন নৈতিকতার মাথা খেয়ে গালিগালাজ, যেন এক একটি বাধা অতিক্রমণ।
বধূ মামলায় মেয়েদেরই বেশি আসা-যাওয়া চলতো মেদিনীপুর জেলে। সর্বোচ্চ তিন মাস আটক রাখা যেত। ৩ মাস আটক থাকার পরে, চার্জশিট না জমা পড়লে জামিন পাওয়া আইনি অধিকার। বধূ কেসের বয়ান বেশ মজার। কেউ কোন দিন বলেনি যে তাদের বউ কষ্টে ছিল অথবা তারা অসন্তুষ্ট ছিল। বাড়ির সবাই বউমাকে ভালবাসতো। বউমা বেশ হাসিখুশি থাকতো। সবই তো খুব ভালো চলছিল। তারা জানে না যে হঠাৎ কী এমন হল যে বৌ গায়ে আগুন লাগালো বা গলায় দড়ি দিল বা বিষ খেলো। খুব বেশি হলে ভালোবাসা থাকতে পারে। যে সমাজ মেয়েদের বোঝা মনে করে, বিয়ে দিয়ে দায়িত্ব মিটিয়ে দেওয়াই যেখানে লক্ষ্য সেখানে মেয়েদের এছাড়া আর কিই বা হবে? বেঁচে থাকাই যাদের জীবনের রোজকার লড়াই তাদের অসময়ে মৃত্যু অবধারিত। মেয়ে বড় হয়েছে, বিয়ে দিয়ে ঝঞ্ঝাটমুক্ত হতে হবে। ভালো থাকলে ভালো। আর না থাকলেই বা কী। ঠাকুর সব সুরাহা করে দেবেন। সে কষ্ট পাক, দুঃখ পাক, মার খাক …. কে শুনছে …..! তার এই দুঃসহ পরিবেশে থেকে বাঁচার কিই বা উপায়! মরা ছাড়া কি আর কোনো পথ রয়েছে তার কাছে? মেয়েটা মরে গেল কিংবা কেউ মেরে ফেললো কী যায় আসে। যারা তাদের মেয়েকে প্রতারিত করলো, সাহায্য করতে পারতো কিন্তু করেনি তাদের কান্না দেখে অবাক হতে হয়। অবাক হতে হয় তাদের মামলা করার তৎপরতা দেখে। বাড়িশুদ্ধু লোকের বিরুদ্ধে এফ–আই–আর। সবাইকে ভরো জেলে। অপর পক্ষও শিখছে …. প্রথমে দু-এক জন আত্মসমর্পণ করে তিন মাস জেলে কাটায়। এরপর আস্তে আস্তে এক এক করে সবাই আত্মসমর্পণ করে ক’দিন জেলে কাটিয়ে বাড়ি ফিরে যায়। তারপর চলে দুপক্ষের দর কষাকষি। অবশেষে কয়েক লক্ষ টাকায় কেস মিটে যায়। যেমন শিবানী দেড় মাস জেলে কাটিয়ে ব্যাগ গুছোতে গুছোতে বললো ‘বাড়ি গিয়ে মেয়ের বাবার মুখে দু’লক্ষ টাকা মেরে কেস তুলিয়ে নেবো’। একটি জলজ্যান্ত মেয়ের জীবনের দাম ২লক্ষ টাকা বা আরও কম! শিবানী কিন্তু একবারও ভাবলো না তার নিজের কথা। তার নিজের জীবনের দাম! মেনে নিয়েছে এটাই নিয়ম। আমি অঙ্ক কষার চেষ্টা করছি তাহলে আমাদের ৫০/৬০ জনের জীবনের দাম কত!
‘বধূ’ কেসে আসা – যাওয়া রোজকার ব্যপার। একদিন এল আট জন, তিনটি মামলায় অভিযুক্ত। একটা ওড়িয়া পরিবার (মা, দুই বউমা আর বছর খানেকের নাতি), অন্যটা (মা, বউমা আর বছর ছয়ের নাতনি) এবং এক ২০/২২ বছরের মেয়ে (হাফ–মার্ডার কেসে)। ওড়িয়া পরিবার বেশ গোছগাছ করে এসেছিলো। ব্যাগ ভর্তি শশা, পেঁয়াজ, কাচালঙ্কা, নুন, চিনি, বিস্কুট ইত্যাদি সব মিলিয়ে প্রায় পনেরো দিনের রসদ নিয়ে এসেছিলো। সবাই বেশ গোল করে বসতো। বাচ্চাটা প্যান্ট ছাড়াই ঘুরে বেড়াতো (ছেলে বলে কথা)। ওড়িয়া মার কাছে জানলাম যে তার ছোট বউমা আগুনে পুড়ে মারা গেছে। বলে সব ভাল ছিল, বউমা বেশ হাসিখুশি ছিল, ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল ছিল, তার মতে কোনো কষ্টই ছিল না বউমার। কেন যে পুড়ে মরলো জানে না। আমি ঠাট্টা করে বলেছিলাম, ‘বোধ হয় ঠান্ডা লাগছিল’। মনে হচ্ছিলো আমাদের সমাজে বধূ হত্যা যেন এক প্যানডেমিক। চায়না আর মিঠু মা-মেয়ে। দু’জনই বড় অহংকারী। ছেলে কন্সটেবল ও ফেরার। জামাই স্কুল টিচার, মাইনে কুড়ি হাজার। ভয়ে দেখা করতে আসে না। ছোট্ট নাতিকে বউয়ের বাবা নিয়ে গেছে। নাতি আবার সাক্ষীও। স্বাভাবিকভাবেই তাই নিয়ে দুজনের খুব চিন্তা। নাতির হেফাজত কী করে পেতে পারে আমার কাছে জানতে চাইলো। আমি মনে মনে হাসলাম আর ভাবলাম ভাল লোকের কাছেই জানতে চেয়েছে!
এসব দেখে রুপা বলতো জেল থেকে অনেক কিছু শিখে যাচ্ছে সে। শাশুড়ি ছেলের হত্যার অভিযোগ দায়ের করেছে বউমা রুপা ও ছোট ছেলের বিরুদ্ধে। তাই রুপা ও তার দেবর মেদিনীপুর জেলে। রুপা খড়গপুরের মেয়ে ও খুব বুদ্ধিমতী। তার দুই ছেলে (১২ ও ৮ বছরের) শাশুড়ি ও জা’এর কাছে ছিল। বলে বাড়ি ফিরে ছেলেরা কথা না শুনলে ও জেলের গল্প শুনিয়ে ভয় দেখাবে। খুব মজার মজার কথা বলতো রুপা। বলতো তার জেলের সব চেয়ে বড় শিক্ষা হলো বউমাকে মেরে জেলে আর একবার ঢ়ুকে পড়া। জেলে কেউ শাসন করার নেই। জেলের সামান্য অসুবিধে ও মানিয়ে নেবে। হাসতে হাসতে বলতো ‘আমি করবোই বাবুর বৌয়ের ওপর অত্যাচার’। রুপা আবার গল্প শোনাতো মজার। যেমন তার দেবরের ছেলে কেনার। দেবরের খুব ছেলের ইচ্ছে ছিল। কিন্তু বউের পরপর দুটি সিজার অপারেশন করে দুটি মেয়ে হওয়ার কারণে আর সাহস করছে না। একদিন কোনো এক বন্ধু মারফৎ জানতে পারে যে স্থানীয় নার্সিংহোমে একটি সদ্যজাত পরিত্যক্ত ছেলে আছে আর ও চাইলে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে নিয়ে নিতে পারে। নার্সিংহোমে তাদের নামে বার্থ সার্টিফিকেটও দিয়ে দেবে। এই কেনা ছেলেটা হল রুপার দেবরের তৃতীয় সন্তান। সত্যরুপাও এইরকম প্রচুর গল্প শোনাতো। যেগুলোর মধ্যে অসময়ে ও অসুরক্ষিত গর্ভপাতের ঘটনাও ছিল। এমন অনেক গল্প জেলে না গেলে জানতেই পারতাম না।
ভবানী, বয়স অনুমানিক ৪৫, ভারিক্কি চেহারা, জোরালো গলার মালিক, নারকোটিক মামলায় কাজলের সঙ্গে অভিযুক্ত। মামলা চলছে গত ৬ বছর ধরে। গাঁজা পাচারের মামলা। নারকোটিক আইনে যদি কোনো লোক ২০কেজি অথবা তার বেশী পরিমাণ গাঁজাসহ ধরা পড়ে তাহলে মামলা নিষ্পত্তি অবধি জামিন হবে না। অনেক সময়ে কেসের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য পুলিশ ২০কেজি গাঁজা দেখিয়ে দেয়। ওরা মনে করে সেইজন্যেই বোধ হয় ওরা দুজনেই জেলের ভিতরে। মামলা চলছে। সাক্ষী জবানবন্দী পর্ব। বারে বারে সমন পাঠানো সত্ত্বেও সাক্ষী আসছে না। বোঝা যাচ্ছিল ওদের আর্থিক অবস্থা বেশ দুর্বল। ড্রাগ মাফিয়ার জাল বিস্তর। গ্রামে গ্রামে তাদের লোক ঘুরে ঘুরে নিঃস্ব মানুষদের এই চক্করে জড়িয়ে ফেলে। জেলে ওদের সাথে কেউ দেখা করতে আসতো না। কোর্ট ডেটে দেখা হত। তখন জামের সময়, আর ব্যারাকের সামনে দালানে বড় জামগাছে ভর্তি জাম হতো। শুনানির দিন ব্যারাকের দরজা খোলার সাথে সাথে ভবানী ও কাজল ছুটে যেতো জাম কুড়াবার জন্য। ব্যাগ ভরে জাম নিয়ে সাধ্যমত সেজে অনেক আশা নিয়ে খুশিমনে যেতো কোর্টে আর ফিরতো বেশ ক্লান্ত, মনমরা হয়ে। ভবানী ও কাজল মহিলা জেলের প্রাচীনতম বাসিন্দা। ভবানী বেশ দেমাকি ও বেপরোয়া। কার সাহস আছে যে ওর কথার উপরে কথা বলে। কাজলকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘জামিনের চেষ্টা করছো না?’ বলেছিল সাজা খুব জোর হবে ১০ বছর, ৬ হয়ে গেছে আরও ২ কেটে যাবে মামলায়, বাকি ২ কাটিয়ে নেবো। ভবানী খুব পুজো করতো, গলা ছেড়ে কীর্তন গাইতো, শনি পুজো, ব্রত উপোসও করতো। শনি পুজোর দুধ, উপোসের ফলাহার সব জোগাড় করতো ভবানী। জেলারকে পটিয়ে জোগাড় করলো বিপত্তারিণী পুজোর উপকরণ। দিনভর চললো পুজোর জোগাড়, লুচি তরকারি রান্না। মেয়েরা পুজোর কাজের মধ্যে যেন জীবন পেল। বাধ সাধলো প্রসাদ ভাগে। ভবানী গেল রেগে। কিছু খেলো না। কারোর অনুরোধ রাখলো না। পরের দিন জেলার এসে বোঝানোর পর শান্ত হলো। ভবানীকে বেশ নেতা গোছের লাগতো। শিক্ষা, সুযোগের অভাব, সর্বোপরি অর্থের অভাব মানুষকে কোথায় ঠেলে দিতে পরে ভবানী তার জলজ্যান্ত উদাহরণ।
ভবানী আর কাজল কেস পার্টনার হলেও তাদের মধ্যে কথাবার্তা বিশেষ ছিল না। কাজল কে লুডো খেলায় হারনো যেতো না। কাজল, রুপা, সত্যরুপা আর আমি খুব লুডো খেলতাম। মুডে এলে কাজল খুব গল্প শোনাতো। একবার শুনিয়েছিল ব্যারাকে আত্মহত্যার গল্প। ওরা শুনেছে যে আগে বন্দীদের মারপিট হতো। শোনাতো গ্রামের গল্প, দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে মেয়ে পাচারের গল্প, যা আজও সত্যি। তিনবার বিক্রি হওয়া বাংলাদেশী মেয়ে রূপালী তখন মেদিনীপুর জেলে। রূপালীকে ইন্ডিয়াতে কাজ দেবে বলে ওর বাবাকে কুড়ি হাজার টাকা দিয়ে ওকে ভারতে আনা হয়। ভারতে রূপালী বিক্রি হয় দুবার, প্রথমে ষাট হাজার টাকায়, পরে হয় আশি হাজারে টাকায়। দীঘা থেকে ওর সাথে সোনালী নামের একটি মেয়েও ধরা পড়ে। রাখা হয় জেল লাগোয়া হোমে, সেখান থেকে পালাতে গিয়ে আবার ধরা পড়ে। এখন দুজনেই মেদিনীপুর জেলে। সোনালী খেজুরির মেয়ে, প্রচণ্ড দারিদ্র্য সহ্য করতে না পেরে দেহ ব্যবসায়ে আসে। বলে তাকে এক রাতে পঞ্চাশ থেকে ষাট জন খদ্দের সামলাতে হতো। তাই এই ধকল সামলাতে তাদের নিতে হতো মাদক। ড্রাগ, ইঞ্জেকশন, মদ, সিগারেট কিছুই বাদ যেত না।
কবিতার কেস না বলে পারছি না। কবিতার ছেলের সঙ্গে তার বাড়িতে প্রাইভেট টিউটারের কাছে আর একটি মেয়েও টিউশন পড়তো। টিউটার আর মেয়ের মধ্যে প্রেম হয়। মাস্টার ছেলেটা চাকরি পাওয়ার পরে বিয়ে করতে রাজি হয় না। মেয়েটা আত্মহত্যা করে। মেয়েটিকে আত্মহননে প্ররোচনার অপরাধে কবিতা জেলে। কবিতা বলে একজন মধ্যস্ততা করছে। মাস্টার এক লক্ষ টাকা দিলে মামলা উঠে যাবে। অবশ্যই মধ্যস্ততাকারী কিছু নেবে। এই দেড় মাসে, ‘মেয়েদের জীবনের দাম কত?’ মনের মধ্যে এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে বারে বারে। শিবানী দু‘লক্ষ ঠিক করেছে, কবিতারা এক লক্ষ আর রুপালি বিক্রি হচ্ছে কখনো ষাট হাজারে আবার কখনো আশি হাজার।
সত্যরুপা, ইউ এ পি এ তে আটক। বাড়ি খেজুরির পানখাই। দোতলা পাকা বাড়িতে বর, তিন ছেলে, দুই বউমা ও এক নাতি নিয়ে থাকতো। ছেলেরা বাড়ি ছিল না। বড় ছেলে দিল্লিতে কাজ করতো। মেজ হলদিয়ায় আর ছোট ওড়িশায় কাজের সন্ধানে। জমি খুবই অল্প, তাতে সবজি চাষ হয়। বাড়তি সবজি বাজারে বিক্রি করে। ভাগে ধানও চাষ করে। অর্থ উপার্জন করে নানান ধরনের কাজ করে। কখনও বাজারে বিক্রি করে কাপড় আবার কখনও ধূপ। গত চার/ পাঁচ বছর ধরে সে সরকারি অনুদানে স্বনির্ভর গোষ্ঠী চালায়। তার মধ্যে একটার নাম ‘মাতঙ্গিনী স্বনির্ভর গোষ্ঠী’। সেখানে ধূপ বানানো শেখানো হয়। তাদের ধূপের বেশ চাহিদা ছিল। মোদ্দা কথা হলো যেখানে দু’পয়সা রোজগারের সন্ধান পায়, সেটা করেই সংসার চালায়। এইভাবে সে তিন ছেলেদের শিক্ষা দিয়েছে। পড়িয়েছে তাদের বউদেরও। একজন এখন প্যারাটিচার আর অন্যজন পড়ছে বিএ। তার গর্ব যে সৎপথে সংসারকে সে নিজে হাতে দাঁড় করিয়েছে। জেলে আসার আগে সে এমএনআরইজিএ স্কিমে কাজ করছিল। ঝামেলা হয় স্কুলের পুকুর সংস্কার নিয়ে। তৃণমুলের পঞ্চায়েত ভাগ না পেয়ে তাকে ধরিয়ে দেয়। আটকের ১১দিন পরে তাকে কাঁথি কোর্টে পেশ করা হয়। পুলিশ হেফাজতের নামে তাকে কাঁথি থানায় বসিয়ে রাখা হয়। মেদিনীপুর জেলে ওর চেয়ে বড় ‘মাওবাদী’ আর কেউ ছিল না সত্যরুপা আমার কাছে জানতে চায় যে সবাই তাকে ‘মহাবাদী’ বলে, ‘মহাবাদী’ কী? ‘মাওবাদী’ বললে খুব রেগে যেতো। রাষ্ট্র যে কত নিষ্ঠুর, ক্ষমতার আলিন্দে যারা আছে তারা যে ক্ষমতার জোরে মানুষকে সন্ত্রস্ত করে রাখে সত্যরুপা তার নিষ্ঠুরতম উদাহরণ। সত্যরুপা জেলে গাইতো,
‘গোটা চালের ভাঙ্গা খুদি, পুলিশ করে ঘোরাঘুরি,
জমি জায়গা ঘর বাড়ি, সবই গেছে চলে রে,
জীবনটা কাটল আমার মেদিনিপুরের জেলে রে।‘
আমাদের সমাজে মেয়েরা যে কত অত্যাচারিত, অবহেলিত ও অবদমিত তার একটা ছোটো টুকরো ছবি মেলে ধরলাম। মনে হয় দারিদ্র্যই এদের প্রধান অপরাধ কারণ শুধু মেদিনীপুর জেলেই নয় দুনিয়ার সব জেলেই কারাবাসীরা দরিদ্র ঘর থেকে আসে। প্রশ্ন জাগে সত্যিই কি সন্ধ্যার মতো মেয়েরা ছোট্ট নাতনিকে মেরে ফেলেছিল আর মেরে ফেলে থাকলে কেনই বা মারলো! ভবানীর মতো হতদরিদ্র মেয়েদের কাছে কি সত্যিই ২০কিলো মাদক ছিল! কেন অকালে তরুণীদের প্রাণ খোয়াতে হয়? বধূহত্যার ঘটনা তো শুধু গরীব পরিবারেই ঘটে না পয়সাওয়ালা ঘরেও ঘটে। পয়সার জোরে সব অপরাধ মিটিয়ে নেয়! কজন ধনী বধূহত্যার দায়ে কারাবাস করে! আর সবশেষে, যদি অর্থের বিনিময় সেক্স কাজ বলে গণ্য হয় তাহলে সোনালী – রুপালি শ্রমিক নয় কেন? কে তারা অপরাধী?
আজকের “লৌহ কপাট” । খুব ভালো লেখা।
মেয়ে বন্দীদের সম্বন্ধে অনেক কিছু জানলাম। আগে ২/৪ জন নকশাল বন্দীর সঙ্গেই শুধু হঠাৎ হঠাৎ দেখা হয়ে যেতো কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে সেই ৭১-৭২ সালে। ওরা আমার দিদির মতো ছিল। আমাকে খুব ভালোবাসতো। তখন ছোটও ছিলাম। বিপ্লব ছাড়া অন্য কোন কথা ভাবতামও না, বলতামও না। আমরা শুধু অপেক্ষা করতাম যে কবে গণফৌজ মার্চ করতে করতে এসে আমাদের ছাড়িয়ে নিয়ে যাবে। বড়ো নেতারা অন্য ফাইল থেকে জানাতো কাছাকাছি এসে গেছে, হয়তো এই বছরেই এসে যাবে। এগুলো সেই সময় আমাদের কাছে বেদবাক্যের মতোই মনে হতো। পি কে দে সরকারের থেকে শেখা নাউন ক্লজ, এডজেকটিভ ক্লজ, ইত্যাদি বাছার মতো নেতাদের বিপ্লবী, সংশোধন বাদী, মধ্যপনথী ইত্যাদি ফটাফট বাছবার ক্ষেত্রে আমার “পারদর্শিতা” মোটামুটি সবাই স্বীকার করতো। সেসব অনেক কথা। আপাতত তোলা থাক।
পরবর্তী কালে জামশেদপুরের সাকচি জেলে কিছুদিন রতন টাটাদের সম্মান ধুলোয় লুটিয়ে দেওয়ার সুবাদে থাকতে গিয়েও পুরুষ বন্দীদেরকেই দেখেছি। তখন সমাজে সাময়িক কিছু নাম ডাক থাকার সুবাদে জেলার ছোটখাটো বন্দীদের আমাদের কাছে পাঠাতো এই বলে যে এরাই তোদের কে জেল থেকে ছাড়িয়ে দিতে পারে। ওরা বেশির ভাগই এমন ছোটখাটো কেসে বছরের পর বছর জেলে রয়েছে যে কেসে দোষী প্রমাণিত হলে হয়তো সাত দিনের সাজাও হবে না।
জেলের অনেক মজার মজার গল্প আছে। সেগুলো আপাতত জমা থাক।
অসামান্য তথ্য সমৃদ্ধ লেখা।আরো কিছু দিক নিয়ে লেখার অনুরোধ রইল।