কানাডার সদ্য আবিষ্কৃত মূলনিবাসী বাচ্চাদের গণকবরের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধ, এডমন্টন, কানাডা।
১লা জুলাই। কানাডা ডে। এই দিনেই ৪টি উপনিবেশ একসাথে মিলিত করে কানাডা রাষ্ট্র তৈরি হয়েছিল। ‘শান্তির’ দেশ, ‘বহু-সংস্কৃতির’ দেশ, ‘উন্নত’ দেশ কানাডা। সেই দেশেই জন্ম দিবসের আগের দিন মাটি খুঁড়ে আবিষ্কৃত হলো ১১৪৫টি মূলনিবাসী বাচ্চার গণকবর। কানাডার আত্তীকরণ নীতির সাক্ষ্য হয়ে, কানাডা রাষ্ট্রের গড়ে ওঠার পেছনের রক্তাক্ত ইতিহাস উন্মোচন করে, কানাডার গর্বের মাল্টি-কালচারাল সম্প্রীতির আখ্যান চুরমার করে এই কবরগুলো জানান দিচ্ছে কিভাবে এই রাষ্ট্র, এই সভ্যতা, এই উন্নয়ন তৈরি হয়েছে ওখানকার মূলনিবাসী মানুষের লাশের উপর, তাঁদের উচ্ছেদ করে লুটে নেওয়া জমির উপর, তাঁদের ভাষা, যাপন, সংস্কৃতিকে নিঃশেষ করে। এই সার সার মৃতদেহের অবশেষ সাক্ষ্য বহন করে কানাডার ঔপনিবেশিক অতীতের – যে ইতিহাসের মূলে রয়েছে বর্ণবিদ্বেষ আর সাম্রাজ্যবাদ। যে ইতিহাস ‘সভ্যতা’র আলো দেখানোর নামে মূলনিবাসী অসংখ্য জাতিগোষ্ঠীর ভাষা, সংস্কৃতি, যাপনকে সম্পূর্ণ নির্মূল করার হাড় হিম করা গল্প। ঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখার জন্য স্থানীয় সংস্কৃতি নির্মূল করতে তাই মিশনারি বোর্ডিং স্কুলগুলোতে মূলনিবাসী বাচ্চাদেরও নির্বিচারে হত্যা করা হয়। চলে হাজার হাজার বাচ্চার মৃতদেহ গোপনে কবর দেওয়ার আয়োজন। সেই মৃতদেহের ভিতের ওপর তৈরি হয় ‘সভ্য’ বাচ্চাদের আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
তবে এই গল্প নতুন নয়। বহু বছর ধরে কানাডার মূলনিবাসী মানুষ তাদের বিরুদ্ধে হওয়া অনাচার নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন। নিজেরাই তদন্ত কমিটি গঠন করে ইতিহাস খুঁড়ে প্রমাণ তুলে এনেছেন। এই কমিটির রিপোর্টেই এর আগে উঠে এসেছে প্রায় ১২০০ মূলনিবাসী মেয়েকে গণহত্যার তথ্যপ্রমাণ। এই রিপোর্টের তথ্যানুসন্ধানেই কানাডার ১৫০টি মিশনারী বোর্ডিং স্কুলে তদন্ত হয়েছে, যে তদন্তে উঠে এসেছে সেই স্কুলের অবশিষ্ট মূলনিবাসী সার্ভাইভারদের হাড় হিম করা বয়ান। তাঁদের ভাষা, সংস্কৃতির উপর হয়ে চলা আগ্রাসনের কথা, নির্মম অত্যাচার, ধর্ষনের কথা। আর সেই সব বয়ানের সমর্থনেই এই দিনে তিনটি স্কুলের মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেল ১১৪৫টি বাচ্চার গণকবরের অবশেষ। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই এবারের কানাডা দিবস বয়কট করার ডাক উঠলো। প্রতিবাদে দিকে দিকে এই বাচ্চাদের স্মৃতিতে স্মৃতিসৌধ তৈরি হলো। দাবি উঠলো মূলনিবাসী মানুষদের প্রতি হয়ে আসা ঐতিহাসিক অনাচার, গণহত্যার বিচার চাই। চাই এই রক্তাক্ত ঔপনিবেশিক ইতিহাসের স্বীকৃতি। দাবি উঠলো, সভ্যতার নামে চলা বর্বরতার জন্য ক্ষমা চাইতে হবে কানাডার ক্যাথলিক চার্চকে। কানাডার ঘটনা আরো একবার উন্মোচন করলো ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে ধর্মীয় মিশন ও সাদা মানুষদের আধিপত্যের জটিল, অথচ অনুক্ত সমীকরণ। কানাডার ১১৪৫টি বাচ্চার গণ কবর তাই একই সাথে সাক্ষ্য দিচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী নিপীড়ন আর রাষ্ট্রীয় হিংসার, সভ্যতা আর উন্নয়নের নামে হয়ে চলা উচ্ছেদ আর গণহত্যার; আধিপত্যকামী শক্তির বিরুদ্ধে মূলনিবাসী মানুষের সুদীর্ঘ সংগ্রামের; কয়েকশো বছর পরেও, নিঃশেষ করে দেওয়ার শত চক্রান্ত সত্ত্বেও মূলনিবাসী মানুষের টিকে থাকার বিদ্রোহী অঙ্গীকারের।
চিত্রঋণঃ এবিসি নিউজ, অস্ট্রেলিয়া।