সংখ্যা ০১
প্রথম বর্ষ, সংখ্যা ১, ৮ই মার্চ ২০২১
সম্পাদকীয় প্রবন্ধ আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারীদিবস – রায়া দেবনাথ খাবার চাই, চাই রুটি- আমেরিকার ১৯১৭-এর খাদ্য দাঙ্গা- সানন্দা দাসগুপ্ত #মিটু এবং দিল্লী আদালতের রায়- সেঁজুতি দত্ত ‘মেয়েদের কবিতা’ বনাম ‘কবিতা’- সঙ্ঘমিত্রা হালদার গদ্য আর কী বা দিতে পারি?- শতাব্দী দাশ মানুষীর হাত- মৌমিতা ঘোষ ঘুরতে ঘুরতে একলা- পারিজাত রায় …
সম্পাদকীয়, মার্চ ২০২১
আজ যখন হিন্দুত্ববাদ নতুন করে অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন এনে নারীবাদী রাজনীতির বহু সংগ্রামের মাধ্যমে ছিনিয়ে আনা অধিকারকে নস্যাৎ করে, আমাদের খাদ্যাভ্যাস, যাপন, যৌনতা সমস্ত কিছুকেই নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, যখন পুঁজির স্বার্থে নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি, কাজের নিশ্চয়তা খর্ব করে; যখন মাহামান্য আদালতের একের পর এক রায় নারীবিদ্বেষে সিলমোহর দেয়, যখন আদালত হুকুম করে যে রাজার দরবারে শুধু ‘স্বামী-স্ত্রীর’ আদলে একরকমের পরিবারই স্বীকৃতি পাবে, তখন এই অবাধ্য, এই বেখাপ্পা প্রান্তিকায়িত মানুষেরাই তাদের যাপন, তাদের জীবন, তাদের দ্রোহের আগুনে সেই খোপগুলোকে পুড়িয়ে ছারখার করে দেন।
একটি বেচারা মটরশুঁটি বা একটি অদ্ভুত গল্প
রূপকথার গল্প পড়তে আমাদের সবারই ভালো লাগে। কিন্তু বেশির ভাগ রূপকথার গল্পেই মেয়েদের চরিত্রটিকে খুবই দুর্বল দেখানো হয়। তোমাদের কি তা ভালো লাগে? আমার তো একদম ভালো লাগে না৷ আজ আমরা “The Princess and the Pea” গল্পের উদাহরণ দিয়ে এই ব্যাপারে আলোচনা করব। গল্পটি আসলে হানস ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসনের লেখা একটি রূপকথা৷ বাংলায় আমরা এর নাম দিতে পারি রাজকন্যা আর মটরশুঁটি।
ঘুরতে ঘুরতে একলা
যাই কারণ সাধারণত মেয়েদের একা ঘুরতে যাওয়া সমাজের কাছে খুবই গর্হিত কাজ, তাই বাড়ীর লোকেদের অনুমতি একেবারেই পাওয়া যায় না। “লোকে কী বলবে?” “কিছু যদি হয়ে যায়?” “বিয়ের পর বরের সাথে যাস।” “ঘুরতে না গেলে কী এমন আহামরি হবে?” ইত্যাদি বিভিন্ন টিপ্পনী প্রায় সব ঘরেই। তাই যাই। পুরুষই পারে মেয়েদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে এই চিন্তাধারা থেকেই জন্ম নেয় ঘুরতে যাওয়ায় এত বিধিনিষেধের। নিজের শারীরিক নিরাপত্তার দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে, সামাজিক প্রতিকূলতা কে তোয়াক্কা না করে নারী ভ্রমণকারীর সংখ্যা বাড়ছে, আমি তার ভাগীদার হতে চাই, তাই যাই। একা ঘুরতে যাওয়ার মধ্যে যে খানিকটা ভয় আর একাকীত্ব মিশে থাকে, ট্রিপ শেষ হলে যে মানুষের প্রতি ভালোবাসা, স্বাধীনচেতনা এবং আত্মবিশ্বাস চারগুণ বেড়ে যায়, তাই যাই।
নিজেকে ভালোবাসতে ভালো লাগে।
আর ভালোবাসা না থাকলে মেয়ে খাবে কী?
#মিটু এবং দিল্লী আদালতের রায়
আমরা কখনও মাথায় রাখিনা যে সংহতি প্রদর্শন রাজনীতির বাইরে নয়। কেউ যখন প্রকাশ্যে নিজের ওপর ঘটে যাওয়া হিংসা এবং হেনস্থার আখ্যান সবার মধ্যে তুলে ধরছে, তখন সে সংহতির দাবী রাখে। অপরদিকে, যখন কেউ অভিযুক্ত হচ্ছে সেও আশ্রয় খুঁজবে নিঃসন্দেহে। এই দুই অবস্থান, সংহতি এবং সহায়তা, কোনভাবেই অরাজনৈতিক হতে পারে না। যারা নিঃশর্ত সংহতি জানানোয় বিশ্বাসী তাদের সমস্যা চারগুণ বেড়ে যায় যখন খবর আসে যে অভিযুক্ত তাদেরই কাছের মানুষ। এই টানাপোড়েন থেকে বেরোবার কোনও সহজ রাস্তা নেই।
খাবার চাই, চাই রুটি- আমেরিকার ১৯১৭-এর খাদ্য দাঙ্গা
পরদিন, অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি মাসের ২০ তারিখ জমায়েতের ডাক দেয় ‘মাদার’স অ্যান্টি-হাই প্রাইস লিগ’। হাজার হাজার মহিলা যোগ দেন জমায়েতে। সভা শেষে ইদা হ্যারিস ও মেরি গানজ্-এর নেতৃত্বে মিছিল এগিয়ে চলে সিটি হলের দিকে। খবর পেয়ে তড়িঘড়ি মেয়র-এর অফিসের লোহার দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ৪০০ জনেরও বেশি মহিলা উঠে যান সিটি হলের সিঁড়ি বেয়ে। অনেকেরই পিঠে বাচ্চা। ইংরেজি ও ইদ্দিশ ভাষায় স্লোগান ওঠে, “খাবার চাই, চাই রুটি, খাবার চাই আমাদের সন্তানদের!”
আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারীদিবস
বেঁচে থাক আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস, হীরের গয়না, নেল পলিশ, শাড়ির দামে ডিসকাউন্ট, ফেয়ার অ্যান্ড লভলির বিজ্ঞাপনের মিথ্যে পুঁজিবাদী ঘেরাটোপ ভেঙে এগিয়ে চলুক স্বমহিমায়। ততদিন, যতদিন না সবক্ষেত্রে সাম্যবাদের জয়ধ্বজা উড়ছে, বুঝে নেওয়া হচ্ছে অধিকারের সব হিসেব নিকেশটা। ইক্যুউটির হাত ধরে এ পৃথিবীর বুকে নেমে আসুক ইক্যুয়ালিটি।
সুলতানার স্বপ্ন
বামা বেগম রোকেয়া সাখাওয়াতের ছোট গল্প ‘সুলতানার স্বপ্ন’-তে যে নারীবাদী কল্পরাজ্যের কথা বলা আছে তার কাল্পনিক চিত্রায়ন। ছবিটি দুর্গাবাই ব্যোমের থেকে অনুপ্রাণিত। ৬নং তিহার জেল থেকে দেবাঙ্গনা কালিতার আঁকা। দেবাঙ্গনা, নাতাশা, গুলফিশারা আজ এক বছর ধরে কারাবন্দী নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার আইনের বিরোধিতা করায়, যে আইন আরও স্পষ্ট করে জানান দেয় যে মেয়েদের কোনো দেশ নাই। …
উইচহাণ্ট
চান্দ্রেয়ী দে ১ বাঁশঝাড়ের আড়াল থেকে অল্প অল্প ধোঁয়া বের হয়ে আসছে। পথ ঘুরে ঘুরে বেঞ্জামিন সেদিকে এগোতে থাকে। ছায়ায় বসে আছে কারা যেন। হাতে ঝুলছে জ্বলন্ত বিড়ি, চোখ সামনের দিকে। নদীর দিকে, পাহাড়ের দিকে, রোদে জলে সাঁতারু বাচ্চাদের দিকে। পিছন থেকে এক পা এক পা করে এগিয়ে আসে বেঞ্জামিন। কাঁহা সে আয়ে হো আপ? …
আর কী বা দিতে পারি?
এই যে তুমি দ্রুত ছুটছ, দিশার বয়সের দিকে, সফুরার বয়সের দিকে, অথচ আমি তোমার বাসযোগ্য করে যেতে পারছি না পৃথিবীকে, গ্লানি হয় তার জন্য৷ আগলাতে পারলে বেশ হত। অন্যথায় বর্ম-টুকু দিয়ে যাই। বড় হয়ে যদি একই স্বৈরাচার, একই অসাম্য দেখো, তাহলে জেনো, মা-মাসিরা লুকিয়ে পড়েনি, পিছু হটেনি। হয়ত পারেনি, কিন্তু চেষ্টা তারা করেছিল। প্রতিরোধ এক যাত্রা। সে যাত্রার শরিক হোয়ো তুমিও। মিছিল-শেষে মিছিলের জনতার মুখের আলো দেখেছ? প্রতিরোধ এক উৎসবও। তাতে সামিল হোয়ো।
প্রতিরোধই একমাত্র বর্ম। তা ছাড়া আর কী বা দিতে পারি?
ঝাঁঝ
নলিনীবালা কখনো সরাসরি কথা বলতে পারেননি স্বামীর মুখে। আর একবার যদি তুমি সরাসরি কথা বলার অভ্যাস হারাও, কারোর সাথেই আর বলতে পারবে না। জমাদার বা কলের মিস্তিরি-র সংগেও না। মানে পুরুষমানুষ হলেই তাকে কোনো কথা বলার আগে পাঁচবার ভাবতেন, মুখ যেন কে আটকে ধরত। মেয়েদের সঙ্গে অবশ্য কোনো সমস্যা নেই। কাজের মেয়ে, তস্য মেয়ে, তাদের মুখ খারাপ করেন নি, কিন্তু বিঁধিয়ে বিঁধিয়ে শুনিয়ে দিতে পারতেন বেশ। সে ভাবে ভেবে দেখলে পুরুষদের সব অন্যায় আবদার সহ্য করে নেওয়া আর মেয়েদের কারুকে কোনদিন ছেড়ে কথা বলেননি নলিনী। মেয়েদের পোশাক, মেয়েদের চলনবলনের উপর খবরদারি করে স্বামীসকাশে নিজের কথা না বলাটাকে উশুল করে নিতেন উনি।
‘মেয়েদের কবিতা’ বনাম ‘কবিতা’
এখনও গল্প-উপন্যাসে সে বাজারজাত কারণে হোক বা সংস্কারজনিত কারণ; অনেক পুরুষই যেমন মেয়েদের নিয়ে লিখতে গিয়ে লম্বা চুল, ভ্রমর কালো আঁখি, পদ্মপাতা মুখের বাইরে বেরিয়ে তার অনুভবের সূক্ষ্মতা, আবেগের বাড়াবাড়ি বা শীতলতা, তার বুদ্ধিদীপ্ত কথা, আলাপ-আলোচনাকে খুব একটা গুরুত্ব দিয়ে উঠতে পারেননি; তেমনি কোনও কোনও মহিলা-লেখকের লেখায় বৌদ্ধিক দিকটি একপ্রকার কুয়াশাচ্ছন্ন বা অন্ধকারেই থাকে। তাঁদের কারও কারও লেখায়ও হাতেপায়ের চুড়ি-গহনার রিনরিন শব্দ-ঢেউ যে এখনও পাওয়া যায় না এমন নয়। মায় ‘কাদের কুলের বউ গো তুমি’র লাজবতী আভাও সেখানে পরিস্ফুট! তবে ছেলেদের লেখালিখিতে কি তাদের নতুন গলা-ভাঙার স্বর লেগে থাকে না? তাদের কারও কারও কবিতায়? অবশ্যই থাকে। তাহলে মেয়েদের ক্ষেত্রেই এত প্রকট কেন সেই অপবাদ?
সরণ
অর্ধেক ডিম খেতে খেতে সে মায়ের চিৎকার শোনে, কি নোংরা নোংরা কথা বলে মা! তাদের বাংলা স্যার বলেন, সুন্দর করে কথা বলাটা একটা শিল্প। প্রতিটা শব্দ ধীরে ধীরে উচ্চারণ করবে। ফ্যাক করে হাসি পায় আভার। স্যারের বাড়িতে সবাই সুন্দর করে কথা বলে! জলপাইগুড়ি থেকে আসেন স্যার। কবিতা লেখেন পত্রিকায়, নিজেই বলেছেন। যদি উনি জানতেন আভাদের বাড়িতে সবাই কেমন করে কথা কয়! মা কথায় কথায় শতেকখোয়ারি, জন্মের পাপ, বথুয়া বলে নিভাকে, তাকেও; মাকে একটুও সুন্দর লাগে না তার। বাবার অফিসের সাহেবের ছেলের বিয়েতে যখন তাদের বাড়ির সবাইকে নেমন্তন্ন করেছিল, জ্বর আসছে বলে যায়নি আভা। আসলে সে ওদের সাথে যেতে চায়নি। মা আর নিভা লাল লিপস্টিক মেখে, রজনীগন্ধা সেন্টের গন্ধ ছড়াতে ছড়াতে গেছিল। ওরা চলে যাওয়ার পর কুয়ার পাড়ে বসে গলায় আঙ্গুল ঢুকিয়ে বমি করে ছিল সে।
মহামারী
এই রাণীর রাজা না থাকলেও স্বামী ছিলেন বিলক্ষণ। তবে বারো বছরের সংক্ষিপ্ত স্বামীসঙ্গে ছয়টি জীবিত ও একটি মৃত সন্তানের গর্ভদানের পর তিনি গত হন, অতঃপর দীর্ঘ চল্লিশ বছরের বৈধব্য। ১০ বছর আগে ইস্তক একফালি জমির শাকসব্জী গাঁটরি বেঁধে কলকাতার বাজারে বেচে আসতেন। একদিন রাত্তিরে স্বপ্ন দেখে হাত-পা ছোঁড়াছুড়ি করতে গিয়ে বাম হাতটা কনুই থেকে ভাঙল। ডাক্তার বলেছিল অপারেশন করতে হবে। মঞ্জুরাণীর চোদ্দগুষ্টির কেউ কোনওদিন অপারেশন করায়নি। হঠাৎ এসে মঞ্জুরাণীর জন্য সে নিয়ম বদলাবে এমনটা কল্পনা করা ভুল। বাস্তবেও তেমনতর কিছু ঘটেনি। মঞ্জুরাণীর কনুই থেকে হাতটা তিনকোণা হয়ে বিপ্রতীপ কোণে বেঁকে ঝুলে থাকল।