তিতির পাখি, ১৯৯৭,
এই নামে তোমায় কেউ ডাকবে না কখনো, তোমার মা তোমায় এই নাম দিয়েছিলেন। তুমি যখন অনেক অনেক ছোট ছিলে, যখন আকাশের রঙ গোলাপি আর বিড়ালেরা বাঘের মতো বড় ছিল, তখন থেকে আমি তোমায় চিনি। আমি তোমার সঙ্গে, তোমার বাড়িতে থাকতাম, আমায় মনে আছে তোমার? আমি তোমার বড়বেলা হই।
তুমি ভেবেছিলে একবার জ্যোতির্বিদ হবে, যাকে এস্ট্রোনমার বলা হয়। তারা দেখতে তোমার খুব ভালো লাগতো। তুমি মনে করতে সব তারাদের রঙ সবুজ। সবুজ প্রিয় রঙ ছিল তোমার, কারণ তুমি মাটি, গাছপালাদের ভালোবাসতে। এখন, বড়বেলায় অবশ্য তোমার নীল রঙ পছন্দ। তোমার চোখদুটো বড় হতে হতে আকাশ ছাড়িয়ে চলে গেছে, তোমার হৃদয়টা এখনো মুঠোয় ধরা যায়। সে বাড়েনি তেমন।
কারণ তুমি চোখ বাড়নোর ব্যায়াম করতে গিয়ে হৃদয়বর্ধক কসরত করায় ফাঁকি দিয়েছ। তাই কোনো রাজনৈতিক মিছিলে তুমি যাও না। প্রতিবাদকে তোমার অকারণ বলে মনে হয়। পৃথিবীকে নয়, নিজেকে বদলে দায় সারতে চাও তুমি। অথচ, ছোটোবেলায় তোমার আফসোস হত, কেন স্বাধীনতার আগে জন্মাওনি, তাহলে দেশের জন্য প্রাণ দিতে পারতে। এখন দেশকে তোমার কেবলমাত্র একটা ধারণা বলে মনে হয়, তুমি বুঝে গেছ তোমার বড় বড় চোখ দিয়ে, যে এটা একটা ভেল্কিবাজি, পি সি সরকারের “ওয়াটার অফ ইন্ডিয়া” ম্যাজিকের মতো, জল শেষ আবার শেষ নয় দুইই।
তিতির পাখি, এই নামে তোমায় কেউ কখনো ডাকবে না, কারণ তুমি এই নামটায় বিশ্বাস করোনি। তুমি মনে করতে তোমার নাম অলোকপর্ণা হতে পারে, দিয়া হতে পারে, এমনকি রাকা-ও হতে পারে, কিন্তু তিতির কখনো নয়। জানবে, তুমি যা বিশ্বাস করো, ঠিক তাই তাই হয়। তাই সবাই ভুলে যাওয়ার আগে, বিশ্বাস করো তিতিরপাখিও তোমার নাম, তোমার মায়ের দেওয়া। তাহলেই ওই নামে তোমায় সবাই চিনবে। তুমি যদি বিশ্বাস করো তুমি উড়তে পার, দেখবে একদিন সত্যিই তোমার পিঠ থেকে দুটো ডানা গজিয়েছে, তোমার ঠোঁট সুচালো হয়ে উঠছে আর তোমার গায়ে লোমকূপ থেকে পালক জন্মাচ্ছে আর তখনই, কেবল তখনই তুমি উড়ত পারছো। তখনই তুমি তিতিরপাখি। পাখি। আকাশ তোমার সবচেয়ে প্রিয়, কারণ আকাশে তারা দেখা যায়। তারারা তোমার বন্ধু, তারা তোমার কথা শোনে, জানে, বিশ্বাস করে, অস্বীকার করে উড়িয়ে দেয় না, নিজেদের মত চাপানোর চেষ্টা করে না। তারাদের মনে রেখো তিতিরপাখি। যখন তোমার সময় আসবে, শুনো, মনে রেখো, স্বীকৃতি দিও, বিশ্বাস কোরো। বিশ্বাস করতে না শিখলে তুমি সাঁতার শিখতে পারবে না। তোমার বাবা তোমায় নিয়ে বছরের পর বছর তুয়াদের পুকুরে গরমকালে অনেক চেষ্টা করেও তোমাকে সাঁতার শেখাতে পারবেন না, কারণ তুমি বিশ্বাস করে বাবার হাতে নিজের প্রাণ ছেড়ে দিতে পারোনি, তুমি জলে নামলেই তোমার অবিশ্বাস তোমার চেয়ে বড় হয়ে তোমাকে কানে কানে বলে, “বাবা আছে তো কী? ডুবে যেতে শুরু করলে কেউ নেই বাঁচানোর। বাঁচতে হলে নিজের পায়ে দাঁড়াও!”
তাই তুমি জোরদার পড়াশোনা করছো, কারণ তুমি মনে করো, পড়াশোনা করলে একদিন ঠিক উড়তে পারা যাবে। অথচ কেউ তোমায় বলেনি, ওড়ার জন্য কেবল ডানা আর হাওয়ার উপর বিশ্বাস প্রয়োজন।
উড়ত গেলে কী কী করতে হবে আমি জানাই তোমায়,
১. রাতে আকাশে মেঘ থাকবে না যখন, তখন চুপিচুপি ছাদে যাবে
২. দুই চোখ বন্ধ করে ধ্রুবতারার দিকে তাকাবে
৩. মনে মনে বলবে, আমি বিশ্বাস করি। I believe.
যদি এমন করতে পারো, আর যদি সত্যি সত্যি বিশ্বাস করতে পারো যে তুমি উড়তে পারবে, তাহলে সত্যিই একদিন দেখবে পরিকল্পনা মাফিক এত পড়াশোনা, এত দুশ্চিন্তা, এত দুঃস্বপ্ন– কিছুই না। তিতিরপাখি, জীবন অতটাও কঠিন না, আবার জলও নয়।
তুমি একদিন স্বপ্ন দেখলে তোমার প্রিয় বিড়ালটার গায়ে কে যেন তারাবাজি জ্বালিয়ে দিয়েছে। বিড়ালটা কষ্ট পেয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেল, স্বপ্নের মধ্যেই। আবার একদিন দেখলে তোমায় জোর করে চিলি অথবা পাপুয়া নিউগিনি পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যেখান থেকে ফিরে আসা খুব কঠিন। তোমার ঘুম ভেঙে গেল। আর তুমি ঠিক করলে, এমন কিছু করতে হবে যাতে কেউ তোমায় কিছুতে জোর না করতে পারে। এরপর তুমি খেলার সময় খেলা বন্ধ করে দিলে, হাসির সময় হাসলে না, কান্নার সময় কাঁদলে না।
তারপর বড় হয়ে একসময় টের পেলে তোমায় এখন আর কেউ কিছুতে জোর করতে পারছে না এটা ঠিক, কিন্তু তোমার মুখ থেকে কোনো আওয়াজ বেরচ্ছে না। তোমার ঠোঁটে হাসি আসছে না। তোমার চোখে একটুও জল নেই। তিতিরপাখি এত কিছু করার কোনো প্রয়োজন নেই, শুধু একবার ছাদে উঠে গিয়ে… বিশ্বাস করো।
দৌড়াও খুব জোরে।
হাসো হা হা করে।
কাঁদো হাউহাউ করে।
কথা বলো, কথা বলো, নাহলে কথা ফুরিয়ে যাবে।
আর মনে রাখো। ছোটোবেলা ভুলে যেও না। মনে রাখো, তুমি কে, মনে রাখো তোমার নাম তিতিরপাখি – মা রেখেছিলেন। ১৯৯০ সালে।
ইতি-
অলোকপর্ণা, ২০২১।