পড়ুন পর্ব ১ | পড়ুন পর্ব ২ | পড়ুন পর্ব ৪| পড়ুন শেষ পর্ব
অমল ঠাকুরদা
“ওরে থাম থাম” বলতে বলতে ছুটি রুটির পিছনে ছুটল! কিন্তু কে কার কথা শোনে! এক্কেবারে গোলাপবাগানে পৌঁছে এক লাফে পাঁচিল টপকে তবে থামল রুটি।
এত্তটা ছুটে হাঁপিয়ে গেছিল ছুটি। তার উপর গরমে দরদর করে ঘামছিল। বড়সড় মাদার গাছটার গায়ে হেলান দিয়ে সে একহাত লম্বা জিভ বের করে হাত নেড়ে নিজেকে হাওয়া করতে লাগল। তারপরে খানিক হাঁপানি কমলে রেগেমেগে বলল, “অমন জোরে ছোটবার কী ছিল বাপু? কথা বলা অমলতাস কোথায় পাব জিজ্ঞেস করে নিতুম না হয়!”
রুটি চোখ পিটপিট করল। “জানি তো।”
“জানিস?”
“হ্যাঁ জানবনা কেন! মতিদিঘির পশ্চিমপাড়ে আমবাগান, আমবাগান পেরোলে কানাপুকুর, আর কানাপুকুর পেরোলেই বুড়ো ঠাকুর্দা অমলতাস।”
“অ।” ছুটির রাগ একটুখানি পড়ল তা শুনে। “কিন্তু তা বলে অমন পাগলের মতো ছুটছিলি কেন বল দেখি?”
“ক’টা বাজে সেই খেয়াল আছে? সূয্যি ঢলে ছায়া লম্বা হতে হতে কানাপুকুরে পড়লেই অমল ঠাকুরদা ঘুমিয়ে পড়ে, বয়স তো আর কম হল না নেহাত। তখন ফুল পাবি কীকরে? দিদিমার ওখানে আর বসে থাকলে দিদিমা এক ধামা মুড়ি না খাইয়ে ছাড়ত নাকি?”
কথাটা নেহাত ফেলনা নয়। আর ছুটিও ক’দিন এমন দেরি করেছে গল্প করতে গিয়ে! মা পইপই করে বলে দিয়েছে, একদম ঘড়ির কাঁটায় ছ’টা বাজার আগে বাড়িতে ঢুকতে হবে। রোজকার মতো দেরি করলে কিছুতেই হবে না। তার আগে অমলতাসের ফুল নিয়ে দিদিমাকে দিয়ে আসতে হবে। তবে কাল পরী দেখা হবে। কাজ কি কম?
“চল চল চল” ছুটি রুটিকে তাড়া দিল। রুটি খানিকটা মুরুব্বির মতো একটা হাসি দিয়ে তারপরে গা ঝাড়া দিয়ে উঠল।
চল চল বলা যত সোজা, যাওয়া তত না। গায়ে গায়ে গাছে গাছ লেগে রয়েছে, তারমধ্যে দিয়ে এদিক ওদিক সরু সরু পায়ে চলা পথ চলে গেছে – রুটি না থাকলে ছুটি নির্ঘাত পথ হারিয়েই ফেলত। রুটির তো দিব্যি মজা, সে এই গাছ ওইগাছে লাফ দিয়ে দিব্যি আগে আগে পথ দেখিয়ে চলতে লাগল। ছুটি ফ্রক সামলে মাকড়সার জাল ডিঙিয়ে, গুবরেপোকার বাসা পিঁপড়েদের ঢিপি এড়িয়ে সাবধানে চলতে লাগল।
মতিদিঘির পাড়ে আমবাগান। গরমের মধ্যে আমপাতার ফাঁক দিয়ে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে, মিষ্টি আঠালো মুকুলের গন্ধ বাতাসে, চারদিকে গাছের ডাল থেকে ইয়া বড় বড় পাকা পাকা আম টসটস করে ঝুলছে। ছুটির আম অতও ভালো লাগে না, কিন্তু এইরকম গাছপাকা আম ঝুলতে দেখে তারও বেশ লোভ লাগতে লাগল। ঝরাপাতায় গাছের তলায় মাটি পুরো গালিচার মত নরম হয়ে বিছিয়ে রয়েছে, দেখলেই মনে হয় শুয়ে খানিক গড়িয়ে নিই।
কিন্তু সময় নেই। কাজেই খানিক দুখ্যু দুখ্যু মনেই ছুটি রুটির পিছনে পিছনে আমবাগান পিছনে ছেড়ে এগোল।
আমবাগানের পরে কানাপুকুর। পুকুর অবশ্য নামেই, জলা বললেই বেশি ভালো বোঝায়। এই ঘোর গ্রীষ্মেও পানায় শ্যাওলায় শ্রাবণ মাসের কোম্পানির মাঠের মত ঘন সবুজ হয়ে রয়েছে। মাঝেমধ্যে পোকা খুঁজতে মাছ ঘাই মারলে একটুখানি সবুজ সরে জল দেখা দিচ্ছে, নইলে জল না ঘাসজমি বোঝে কার সাধ্যি? জলার মধ্যে দিয়ে সরু একচিলতে পথ, ছুটি তো ভুল করে বেশ ক’বার শক্ত পথের ধারে কাদায় পা দিয়ে ফেলল।
কানাপুকুরের কাদাও এমনি কাদার মত নয়, ঘাসের তলায় লুকোনো। পা পড়লেই মাটি ভুসভুস করে ঢুকে যায়, খুদে খুদে কাদাপোকা সুড়সুড়ি পিঁপড়েরা সব হুড়মুড় করে ছোটাছুটি শুরু করে দেয়। পা উঠিয়ে নিলে মাটি আবার কলের স্প্রিঙের মত উঠে আসে, ঘাসের মধ্যে পায়ের ছাপটুকুও আর পড়ে থাকে না।
“চল চল চল” রুটি তাড়া দিলে। “এই জায়গাটা ভালো না।”
অবশেষে তারা কানাপুকুর পেরিয়ে আবার শক্ত মাটিতে পা রাখল। রুটিও এবার খানিক থেমে হাঁপ নিতে লাগল। ছুটির তো বুকের ভিতর এত জোরে ধুকপুক করছিল মনে হল এইবার বুঝি হৃৎপিণ্ডটা ছিঁড়েই বেরিয়ে আসবে !
“ওই দ্যাখ।” রুটি হাঁপাতে হাঁপাতেই বলল, “বুড়োঠাকুরদা।”
সামনে পাতলা গাছের সারি। গাছের সারির ওপারে একটুখানি খোলা ঘাসজমি, আর সেই ঘাসজমির উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা পেল্লায় অমলতাস গাছ। বিকেলের সূর্যের আলো তার সোনালি ঝুড়ির মতো ফুলগুলোয় পড়ে ঝলসে উঠছে যেন। ডালের মধ্যে দিয়ে হাওয়া দিচ্ছে, মোটা মোটা ডালগুলো মড়মড় করে নড়ে উঠছে।
“ও মা! কী সুন্দর!” ছুটি বলে উঠল।
“শোন” রুটি সাবধান করে দিল, “বুড়োঠাকুরদা মানুষ খুব ভালো, কিন্তু একটু কানে কম শোনে। একটু চেঁচিয়ে কথা বলতে হবে কিন্তু।” তারপরে এগিয়ে গিয়ে চেঁচাতে লাগল, “ঠাকুর্দা! বলি ও ঠাকুর্দা!” কিন্তু রুটির মিহি গলার স্বর হাওয়ার শনশন গাছের ডালের মটমটের মধ্যেই কোথায় হারিয়ে গেল, ঠাকুর্দার কান অবধি পৌঁছালই না!
এইবার ছুটি চেষ্টা করে দেখল। এগিয়ে একদম গাছতলায় গিয়ে সে প্রাণপণে চেঁচাল, “বু – ড়ো – ঠা – কু – র্দা – আ – আ!”
প্রথম কয়েক মুহূর্ত কিছুই হল না। তারপরে হঠাৎ করে যেন পাখির কিচমিচ থেমে গেল, গাছের ডালের মড়মড় কমে গেল, হাওয়ার শনশন একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। চারপাশটাই কেমন চুপ হয়ে এই ভর বিকেলেও গা ছমছমে নিশুতি মতন হয়ে গেল। ছুটির হাতের পিছনের লোমগুলো সব আপনা থেকেই খাড়া হয়ে উঠল।
তারপরে নৈঃশব্দ ভেঙে একটা ফ্যাঁসফ্যাঁসে গম্ভীর গলা ভেসে এল, “কে? কে ডাকে রে?”
“আজ্ঞে ঠাকুর্দা আমি ছুটি।”
“পুঁটি? না না বাপু আমি মাছটাছ খাইনে কতবার বলব।” বুড়োঠাকুর্দা গায়ের ডাল ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল। সেই ঝাঁকুনিতে বাসা ছেড়ে দু একটা বুলবুলি চ্যাঁ চ্যাঁ করতে করতে উড়ে গেল, এক গোছা হলদে বাদামি পাতা টুপ টুপ বৃষ্টির মতো মাটিতে ঝরে পড়ল।
“পুঁটি না। ছুটি। ছু – টি – ই।”
“অ। ছুটি।” বুড়োঠাকুর্দা খানিক চুপ থেকে আবার মড়মড় করে বলল, “কে ছুটি? কী চাই? আমি তো এই নামে কাউকে চিনি না…”
“আমি ছুটি ঘোষ, বয়স সোয়া আট, হাইট তিন ফুট এগারো ইঞ্চি, বাড়ি কোম্পানিপাড়ায়। বলছি, তোমার গাছের কটা ফুল আমাকে দেবে গো?”
“কুল? এই ভর বিকেলে কুল কোথা দিয়ে পাব!”
“কুল না, ফুল। ফু – উ – ল।” কী বিপদ! এইভাবে তো কিছুতেই বোঝানো যাবে না, ছুটি কোমরে হাত দিয়ে ভাবতে লাগল।
রুটি বেশ গম্ভীর হয়ে লেজ নাড়াতে নাড়াতে উপায় ভাবছিল। সত্যি কথাই তো! এরকম করে ঠাকুরদাকে সব বোঝাতে গেলে বিকেল কেন রাত্তিরও কাবার হয়ে যাবে, তাতেও সব কথা শেষ হবে না! তারপরে কি একটা বুদ্ধি মাথায় আসতে সে বলল, “দাঁড়া আমি দেখছি।”
রুটির বুদ্ধিটা মন্দ না। তরতর করে সে বুড়োঠাকুর্দার গা বেয়ে সোজা উঠে গেল। তারপরে একদম উপরের দিকে একটা কোটরের কাছে গিয়ে গিয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ঠাকুর্দাকে শুনিয়ে শুনিয়ে কথা বলতে লাগল। ছুটির কাঠপরী দেখবার শখ, গড়াই দিদিমার বাড়ির গল্প, গড়াই দিদিমা কেন কী চেয়ে পাঠিয়েছে সঅঅব।
এত নীচ থেকে ছুটি হাওয়ায় ভেসে আসা ছেঁড়া ছেঁড়া কথা শুনতে পাচ্ছিল। কিন্তু বুড়ো ঠাকুর্দা বোধহয় দিব্যি মন দিয়েই রুটির সব কথা শুনছিল। শুনতে শুনতে মাঝেমধ্যে গায়ের ডালপালা ঝাঁকাচ্ছিল, আর অমনি মিঠিমিঠি হাওয়া ছুটির গায়ে চুলের গোড়ায় এসে লাগছিল।
বেশ পাঁচ সাত মিনিট ধরে গোটা পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার পর রুটি আবার মাটিতে নেমে এল। অমল ঠাকুর্দা বুঝল কি? যদি ফুল দিতে রাজি না হয় তাইলে কী হবে?
অমল ঠাকুর্দা অবশ্য সব শুনে বেশ ডালপালা কাঁপিয়ে হেসে উঠল। “ফুল নিতে ইচ্ছে হয়েছে? তা নে না, কি আছে!” বলে অমনি নিজের একখানা ডাল একদম ছুটির নাক বরাবর অবধি বাড়িয়ে দিল। ছুটি খুশিতে ডগমগ হয়ে ডাল থেকে কয়েকটা ফুল পেড়ে কোঁচড়ে নিল। এই গোটা ব্যাপারটা এত্ত সহজে হয়ে যাবে সে ভাবেওনি মোটে! তাইলে আর কাল রাত্তিরে তার কাঠপরী দেখা ঠেকায় কে?
আজ সারাদিন এত দৌড়াদৌড়ি হয়েছে, কিন্তু তাও ছুটির সব ক্লান্তি যেন কোথায় উবে গেল! ছুটি রুটি দুজনে বেশ ছুটে ছুটে গিয়ে পাঁচিল টপকে বড়বাড়ি গিয়ে উল্টোমুখ করে পাঁচিল টপকে গড়াই দিদিমাকে ফুল দিয়ে এল।
“ওরে বেগুনি ভাজছিলাম, দুটো খেয়ে যা?” গড়াই দিদিমা অনুযোগ করল।
“না গো দিদিমা, আজ দেরি হয়ে যাবে। মা বকবে। পরের দিন খাব?”
“ম্যাঁওওও।” দাদাঠাকুর লেজ নাড়তে নাড়তে সম্মতি জানাল। গরম গরম বেগুনির ভাগ দিতে সে রাজি নয় মোটেও।
ছুটির মন এতই খুশি যে সে এমনকি দাদাঠাকুরের মোটাসোটা দুটো গাল টেনে আদরও করে দিল। দাদাঠাকুর খিমচাতে আসলে তবে ছাড়ল।
অবশেষে পাঁচিল টপকে রুটিকে টাটা করে ছুটি বেশ লাফাতে লাফাতে বাড়ির দিকে যেতে লাগল। খানিকক্ষণ আগে কোম্পানির পাঁচটার ভোঁ বেজেছে সবে, তার মানে ছ’টা বাজেওনি এখনও। গড়াইদিদিমার ফুলও জোগাড় হল, মায়ের কথাও রাখা হল। তার উপর ছুটি দুপুরবেলা বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় রান্নাঘরে উঁকি মেরে দেখে এসেছে, মা চিংড়িমাছে নুন হলুদ মাখাচ্ছে আর বাবা নারকেল কুটছে। তার মানে তো আজ রাত্তিরে মহাভোজ! সাদা সাদা সুগন্ধী চালের ভাত, গন্ধরাজ লেবু, আর চিংড়িমাছের মালাইকারির কথা ভেবে ছুটির জিভে আপনাপনি জল চলে এল। সব অবশ্য খেয়ে শেষ করে দেওয়া যাবে না, তার ভাগের থেকে কালকে রুটির জন্য একটুখানি বাঁচিয়ে রাখতে হবে!
উৎসাহে ছুটির যেন আর তরই সয় না! লাফাতে লাফাতে ফ্ল্যাটের দরজা অবধি সে প্রায় হাওয়ায় ভাসতে ভাসতেই পৌঁছে গেল। পৌঁছে জুতো খুলতে খুলতে অবশ্য প্রথম একটা খটকা লাগল ছুটির।
পাপোশের উপর একজোড়া চটি বেশি রাখা কেন? আর কারই বা চটি এইখানা, এরকম গোলাপি ফুল ফুল চটি পরতে তো সে একজনকেই দেখেছে! তাইলে কী…? আচমকাই ছুটির বুকটা কেমন যেন ধুকধুক করতে লাগল।
“আমি বাড়ি এসে গেছি” খানিক ভয়ে ভয়েই দরজাটা খুলে সে থমকে গেল।
টেবিলে চেয়ারে আষাঢ়ের মেঘের মতো গোমড়া মুখ করে বসে রয়েছে ছুটির মা, আর তার পাশের চেয়ারে বিচ্ছিরি একটা মিচকি হাসি মুখে…গড়াইকাকীমা।
. . . চলবে
ছবি এঁকেছেন স্নেহা বিশ্বাস