১১ই জুলাই ১৯৯৬। রাতের অন্ধকারে বিহারের ভোজপুরের বাথানীটোলা গ্রামে রণবীর সেনার উচ্চবর্ণ জমিদার বাহিনী ঢুকে পড়লো। জ্বালিয়ে দিল দলিত, মুসলিম পরিবারের সমস্ত ঘরবাড়ি। ত্রিশূলে গেঁথে ফেলল অচ্ছুত নিম্নবর্ণ ভ্রূণ, দুগ্ধপোষ্য শিশু। গর্ভবতী মহিলা সহ অন্যান্য নারীদেহের ওপর চালাল অবাধ গণধর্ষণ। মারা গেলেন ২১ জন। তাঁদের অপরাধ ছিল, তাঁরা দলিত বা মুসলিম। অপরাধ ছিল ক্ষেতের কাজের দৈনিক মজুরি বাড়ানোর দাবি করা। তাই রণবীর সেনার উঁচুজাতের জমিদার বংশের পুরুষরা শিক্ষা দিলেন। দলিত, মুসলিম, নারী, মজুরের শরীরের ওপর নির্বিচারে ক্ষমতা প্রদর্শন করে বুঝিয়ে দিলেন তাঁদের কথামতো না চললে দিকে দিকে বাথানীটোলা হবে। আর হলোও তাই। ১৯৯৬-এর হাত ধরে বিহারের লছমনপুর-বাথে, গুজরাতের গোধরা, মহারাষ্ট্রের খৈরলানজি, হরিয়ানার মির্চপুর, তামিলনাড়ুর ধর্মপুরীতে একের পর এক জ্বালিয়ে দেওয়া হল কয়েকশ দলিত পরিবার, মুসলিম পরিবারের ঘরবাড়ি। নির্বিচারে পুড়িয়ে, গুলি চালিয়ে, কুপিয়ে খুন করা হলো। আরও সাম্প্রতিককালে আমরা দেখলাম মুজঃফরনগর, হাথরাস, দিল্লিতে দলিত আর মুসলিম নিধনের সমারোহ।
প্রায় কোনও ঘটনাতেই অভিযুক্তদের শাস্তি হলো না। বেশিরভাগ ঘটনাতে দোষীরা অভিযুক্তই হলেন না। যে কজন হলেন, মহামান্য আদালতের রায়ে তাঁরাও প্রমাণাভাবে ছাড়া পেলেন। তাঁদের জমিজমা, ক্ষমতার রমরমা অটুট রেখে উচ্চপদে আসীন হলেন। অথচ, গতমাসেই আমরা দেখলাম দিল্লী হাইকোর্টের রায়ে জামিন পেলেন দিল্লি ‘দাঙ্গা’য় অভিযুক্ত দেবাঙ্গনা কলিতা, নাতাশা নারওয়াল, ছাড়া পেলেন আসিফ ইকবাল তনহা। মহারাষ্ট্রে ছাড়া পেলেন উগ্রপন্থী হিসেবে বন্দী মহম্মদ ইরফান গাউস, ইলিয়াস মহম্মদ আকবর। কর্ণাটকে ছাড়া পেলেন দাঙ্গায় অভিযুক্ত মুজামিল পাশা সহ ১১৫ জন মুসলিম বন্দী। এই সব রায়েই বলা হলো উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে তাঁদের জামিন বা মুক্তি দেওয়া হচ্ছে। যে প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও তাঁরা কখনো এক বছর, কখনো দশবছর জেল খাটলেন।
গণহত্যাকে ‘দাঙ্গা’ হিসেবে অভিহিত করার একটা সুনির্দিষ্ট রাজনীতি আছে। সে রাজনীতি ক্ষমতার উচ্চ স্তরে থাকা মানুষকে আগলে রাখার রাজনীতি। যাতে বলা যায় হত্যার ঘটনায় আসলে দু’পক্ষেরই সমান ইন্ধন ছিল, সংগঠিতভাবে প্রান্তিক মানুষের উপর, সংখ্যালঘু মানুষের উপর আক্রমণ হয়নি। এই ‘দাঙ্গা’-র দায়েই অভিযুক্ত ছিলেন নারী আন্দোলন, অধিকার-রক্ষা আন্দোলনের কর্মী দেবাঙ্গনা, নাতাশা, আসিফ-রা। অথচ, ক্যামেরার ফুটেজে যিনি শাহীনবাগে গুলি চালালেন তাঁর মুখ স্পষ্ট ধরা পড়লেও তিনি অভিযুক্ত হলেন না। বিজেপির বিভিন্ন নেতার বক্তব্যে মুসলিম নিধনের উস্কানির সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকা সত্ত্বেও ধরা পড়লেন না তাঁরা। এই পরিস্থিতিতে তাহলে দেশের আইনব্যবস্থাকে আমরা বিনা প্রশ্নে কীভাবে দেখব? কীভাবে বিশ্বাস করব যে আইন-আদালত ক্ষমতার কাঠামোর বাইরে প্রকৃত ন্যায়ের দিকে আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাবে? দীর্ঘদিন বিনা প্রমাণে জেল খাটার পর আমাদের বন্ধু নাতাশা, দেবাঙ্গনার এই সাময়িক স্বস্তিকে আমরা নিশ্চিতভাবে অভিবাদন জানাই। কিন্তু আমরা মনে রাখবো যে তাঁরা শুধুই জামিন পেয়েছেন, মুক্তি না। যে মামলায় তাঁরা অভিযুক্ত, সেই মামলার শুনানি এখনও শুরুই হয়নি – সামনের পথ বন্ধুর, এবং দীর্ঘ। আমরা এটাও মনে রাখবো, মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট এঁদের জামিনের দরখাস্ত মঞ্জুর করার সময় বলেছেন এই রায় স্বতন্ত্র, এই রায়কে কখনোই অন্য রাজনৈতিক বন্দীদের মামলার ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হিসাবে ব্যবহার করা যাবে না।
সদ্য প্রয়াত হয়েছেন তালোজা জেলে ইউএপিএ-র অধীনে রাজনৈতিক বন্দী স্ট্যান স্বামী। যে গুরুতর অপরাধের মামলাগুলোর তিন বছর ধরে শুনানিই শুরু হয়নি, অন্যান্য মামলার সাথে সেই ভীমা-কোরেগাঁও মামলায় অভিযুক্ত বন্দী ছিলেন তিনি। ‘সন্ত্রাস’-এর আশঙ্কায় ৮৭ বছরের দীর্ঘদিনের আন্দোলনকর্মী, পারকিনসন্স রোগে ভোগা স্ট্যানকে জল খাওয়ার সীপারটুকুও দেয়নি জেল কর্তৃপক্ষ। স্বাস্থ্যের ক্রমাবনতির কথা বারবার উঁচু মহলে জানানোর পরেও যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। স্ট্যানের বিরুদ্ধে সাজানো মামলা নিয়ে সম্প্রতি সরব হয়েছে আন্তর্জাতিক বহু মিডিয়া এবং মানবাধিকার সংগঠন, প্রকাশ পেয়েছে কীভাবে স্ট্যান সহ অনেক অভিযুক্তের ই-মেলে সবার অগোচরে তথ্য স্থাপন করা হয়েছে। স্ট্যানের জীবন স্মরণে রেখে এই সংখ্যায় আমরা প্রকাশ করছি স্ট্যানের লেখার অনুবাদ – আমরা দেখছি স্ট্যান বারবার আমাদের জানাচ্ছেন জেলের ভিতরে এবং বাইরে তাঁর উপর নেমে আসা আক্রমণের কথা, তুলে ধরছেন তাঁর মতো আরও অসংখ্য বন্দীর অবস্থা, আহ্বান রাখছেন তাঁদের লড়াই-এ সহযোগিতার জন্য।
মার্চ, ২০২১-এ গৃহমন্ত্রকের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ইউএপিএ-র অধীনে অভিযুক্তদের মাত্র ২.২ শতাংশের মামলার নিষ্পত্তি হয়। যে আইনে মামলার শুনানি এবং নিষ্পত্তির হার এতই কম, স্বাভাবিকভাবেই সেখানে আইনি নিদান নয়, বরং দীর্ঘদিন বিনা বিচারে বন্দী করে রাখার প্রক্রিয়াই হয়ে ওঠে অভিযুক্তের শাস্তি। তিহার, তালোজা, আলিপুর সহ বিভিন্ন জেলে বন্দী রয়েছেন গণ আন্দোলন, অধিকার আন্দোলনের কর্মীরা। বন্দী রয়েছেন কয়েকশো প্রান্তিক মানুষ। ২০১৬ সাল থেকে ২০১৯ সালের ভিতরে সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৫৯২২ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন ইউএপিএ আইনের অধীনে। করোনা মহামারীর সময়ে তাঁদের ন্যূনতম স্বাস্থ্য পরিষেবার অধিকার নেই, অধিকার নেই ছ’ফুট ‘সামাজিক’ দূরত্বের। এই দিল্লি ‘দাঙ্গা’র অভিযোগেই অভিযুক্ত গুলফিশা ফাতিমা সহ অনেকে এখনও জেলে বন্দী, কিছুদিন আগে পর্যন্ত গর্ভাবস্থায় জেলে বন্দী ছিলেন সাফুরা জারগার। নাগরিক সংশোধনী বিল বিরোধী আন্দোলনের অসংখ্য জানা-অজানা মুখ রাজদ্রোহ বা উগ্রপন্থার অভিযোগে অভিযুক্ত। অভিযুক্ত শরজীল ইমাম, উমর খালিদের মুক্তি হয়নি। ভীমা-কোরেগাঁও মামলায় অভিযুক্ত বন্দীদের মামলার শুনানি এখনো বাকি। বন্দী আন্দোলনকর্মী হিদমে মরকম সহ অসংখ্য আদিবাসী। ইউএপিএ-র মতো ‘বিশেষ ক্ষমতাবিশিষ্ট’ আইনের অধীনে অধিকার নেই তাঁদের নিজেদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ের আবেদন করার। আদালতের রায়ে এটা স্পষ্ট, যে বাকি রাজনৈতিক বন্দীদের মামলার ক্ষেত্রে কখনোই দেবাঙ্গনা বা নাতাশার মুক্তি কোনও আইনি স্বস্তির পথ সুগম করে দেবে না। আর তাই জুলাই মাসে বামায় উঠে আসছে আদালতের রায়ে প্রচ্ছন্ন রাজনীতির কথা, আলোচিত হচ্ছে সংবিধানে দলিত-নিধনের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নথিভুক্ত থাকা সত্ত্বেও ভারতবর্ষে দলিতদের উপর অত্যাচারের ইতিহাস।
এই সংখ্যায় আমরা প্রশ্ন করছি ক্ষমতার কাঠামোকে – যে ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ রাষ্ট্র, আদালত, সমাজ-রাজনীতি পেরিয়ে আমাদের প্রত্যেকের অফিস-কাছারি, স্কুল-কলেজ, এমনকি ঘর ও পরিবারের মধ্যেও আমরা প্রতিদিন দেখতে পাই। আমরা দেখলাম রাজ্যে অফিস-কাছারি খুলে রেখে সাধারণ মানুষের একমাত্র যাতায়াতের ব্যবস্থা লোকাল ট্রেন বন্ধ করে দেওয়া হলো। আমরা দেখলাম লোকাল ট্রেন চালানোর দাবিতে স্টেশনে স্টেশনে জমায়েত। দেখলাম কীভাবে কোলকাতার ঝাঁ-চকচকে মলগুলোতে করোনা টিকাকরণের প্রধান শর্ত হয়ে উঠলো গাড়ি। বলা হলো বিনামূল্যে টিকা তখনই নিতে পারবেন যদি আপনি চারচাকার গাড়ি চেপে টিকা নিতে আসেন। দেখলাম স্বাস্থ্যব্যবস্থার বেসরকারিকরণের ভয়ানক ফলাফল। দেশজুড়ে মৃত্যুমিছিল। এইসময়েই আমরা দেখলাম এই মৃত্যু কীভাবে বারবার অস্বীকার করা হলো। এলাহাবাদ হাইকোর্ট রায় দিল উত্তরপ্রদেশে গঙ্গার ধারে সারি সারি শবদেহ সম্পর্কে সরকারের কাছে কোনও তথ্যানুসন্ধান করা যাবে না। আমরা দেখলাম করোনা মহামারীকে জাতীয় দুর্বিপাক ঘোষণা করা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় সরকার মহামারীতে মৃত প্রায় ৪ লক্ষ মানুষের পরিবারকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে অস্বীকার করলো। তাই মহামারীর প্রেক্ষাপটে পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্যব্যবস্থার বর্তমান চিত্র উঠে আসছে এই সংখ্যায়।
অন্যদিকে, ভারতবর্ষের বাস্তব অবস্থায় বেশিরভাগ শিশুর কাছেই শিক্ষার মৌলিক অধিকার অলীক স্বপ্নমাত্র। বেশিরভাগ শিশু অভুক্ত, স্কুলছুট; অনেক সদস্যের সংসার চালানোর জন্য বেশিরভাগ বাচ্চাকেই দোকানে, কারখানায় খাটতে হয়। অথচ, আমরা দেখছি জোর করে সবজায়গায় চালু করা হয়েছে অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা, নতুন শিক্ষানীতি বলবৎ করতে জোর করে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে লাগু করা হচ্ছে কম্প্যুটার, মোবাইল, ইন্টারনেট নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা। শিক্ষা আর অধিকার নয়, হয়ে উঠছে উচ্চবিত্তের, ক্ষমতাশালী মানুষের কুক্ষিগত পরিষেবা, টাকার বিনিময়ে লভ্য পণ্য। মহামারীকে কাজে লাগিয়ে দ্রুততার সাথে তৈরি হচ্ছে ডিজিটাল বিভাজন, যার ভয়াবহ শিকার হচ্ছেন প্রান্তিক অবস্থানের শিক্ষার্থীরা। অনেক সময়েই আমরা ভাবতে ভালোবাসি, ছোটরা, ছোটবেলা আসলে সমাজ-রাজনীতির বাইরে। অথচ বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা দেখি অর্থনীতি, সমাজ, রাজনীতির বিভিন্ন সিদ্ধান্ত কীভাবে ছাপ ফেলে শৈশব, কৈশোরের ওপর। সদ্য আমরা দেখলাম কানাডার ক্যাথলিক স্কুলে আবিষ্কৃত হল আমেরিকা মহাদেশের মূলনিবাসী জাতিগোষ্ঠীর হাজার হাজার বাচ্চার মৃতদেহ। দেখলাম ঔপনিবেশিক শক্তির ক্ষমতার হাত কীভাবে শৈশবকে টুঁটি টিপে মেরে ফেলে। এই প্রসঙ্গেই আমরা দেখি তিথি ভট্টাচার্যের লেখায়, নিজের সন্তানের মুখ দেখে কীভাবে বারবার তাঁর মনে পড়ে প্যালেস্টাইনের স্মৃতি, যেখানে ফুল-পাখি-রামধনু ছেড়ে রিফিউজি বাচ্চারা আঁকে বোমাবর্ষণের ছবি।
অথচ এই ক্ষমতার আস্ফালনের বিরুদ্ধেই আমাদের পথ চলা। এই জুলাই মাসে হিংসা, যুদ্ধ, দমনপীড়ন আর হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি তাই আমরা স্মরণ করি ক্ষমতার বিরুদ্ধতার, প্রতিরোধ আর প্রতিবাদের ইতিহাস। আগ্রাসন আর আধিপত্যের বিরুদ্ধে রোজাভায় নারীবাহিনীর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলন তার স্বাধীন দেশের সীমানার ভিতরে আমাদের স্বাগত জানায় এই জুলাই মাসেই। জুলাই মাসেই স্পেনের মাটিতে গণতন্ত্রের দাবিতে, সম্পদের পুনর্বন্টনের দাবিতে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। ১৯৫৬ সালে এই জুলাই মাসেই বাতিস্তার স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে প্রবল গেরিলা আঘাত হেনে শুরু হয় কিউবা বিপ্লব। দীর্ঘ লড়াইয়ের পর প্রতিষ্ঠিত হয় সমাজতান্ত্রিক কিউবা। এই বিপ্লব সফল করার পিছনে ছিলেন বহু লড়াকু মহিলা বিপ্লবী। সেলিয়া স্যাঞ্চেজ ম্যান্দুলে গড়ে তোলেন সশস্ত্র বাহিনী; হাইদি সান্তামারিয়া, মেলবা হারনান্দেজ বিপ্লবীবাহিনীর নেতৃত্ব দেন। এই প্রসঙ্গেই আমরা স্মরণ করেছি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম, এবং পরবর্তীকালে বামপন্থী আন্দোলনের অন্যতম কর্মী কল্পনা দত্তকে, যাঁর জন্মদিন এই জুলাই মাসে। চট্টগ্রামে সশস্ত্র আঘাতের মাধ্যমে অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের মধ্য দিয়ে যে কল্পনার প্রতিরোধের আঙিনায় পা রাখা, সেই কল্পনাই আবার ১৯৮৩-এর মন্বন্তর, ১৯৪৭-এর দেশভাগের অক্লান্ত ত্রাণকর্মী। এই জুলাই মাসেই থাংজাম মনোরমার ধর্ষণের বিরুদ্ধে মণিপুরে ভারতীয় আর্মির শিবিরে প্রতিবাদের গর্জে ওঠা। জুলাই মাসেই আমরা মনে করছি ক্লারা জেটকিনকে যিনি বামপন্থী ভাবধারার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জুড়েছিলেন নারীমুক্তির প্রশ্ন। সারা পৃথিবীকে ভাবতে বাধ্য করেছিলেন, নারীমুক্তি ছাড়া মানবমুক্তি, শ্রমজীবী মানুষের মুক্তি কখনোই সম্ভব হতে পারেনা।
অন্যদিকে প্রতিরোধের বহিঃপ্রকাশ বহুস্বরের দাবিদার। সেই প্রতিরোধ কাথে কোলভিৎজের যুদ্ধ-বিরোধী ছবিতে বারবার উঠে আসে। তেমনই উঠে আসে মেক্সিকান কম্যুনিস্ট পার্টির একসময়ের সদস্য ফ্রিডা কাহলোর শিল্পভাবনায়। তাই এই সংখ্যায় আমরা ফিরে দেখি সেইসব শিল্পীদের যাঁদের এখন বহুমূল্য প্রসাধনীর বিজ্ঞাপন, এলিট গ্যালারি আর ড্রয়িংরুমে স্থান হয়েছে – অথচ যাঁদের শিল্পের ভাষা ছিল বিদ্বেষ এবং বিভাজনের বিরুদ্ধে, যাঁরা জোরকন্ঠে বলেছিলেন, ‘যুদ্ধ আর নয়,’ স্পেনের গৃহযুদ্ধে অভিযুক্ত পলাতক বিপ্লবীদের আশ্রয় দিয়েছিলেন নিজের ঘরে। আমরা দেখি শার্লট পারকিন্স গিলম্যানের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে উঠে আসছে, কীভাবে আমাদের অর্থনৈতিক কাঠামোয় নারীশ্রমের উপর নির্ভরশীল হওয়া সত্ত্বেও লিঙ্গ ক্ষমতার বিন্যাস বজায় রাখতে সেই শ্রম উহ্য রেখে দেওয়া হয়। ফ্রানৎস ফ্যাননের লেখা ফিরে দেখি আমরা, যেখানে তিনি আলজেরিয়ার বিপ্লবী নারীদের কথা লিখছেন; তুলে ধরছেন ফরাসী আধিপত্য আর পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী নারীদের একসাথে প্রতিরোধের চিত্র।
আর তাই, আমাদের চারপাশের শোক আর শোষণের গ্লানি যখন আমাদের প্রত্যেকের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করছে, তখন দ্রোহের ইতিহাস মনে রেখে, স্বৈরাচারী নিপীড়নকে ক্ষমা না করার শপথ নিয়ে, ক্ষমতার কাঠামো উপড়ে ফেলতে চাওয়ার উত্তরাধিকার বহন করে আমরা প্রকাশ করছি বামার জুলাই সংখ্যা।