মে মাস শ্রমিক দিবসের মাস, মে মাস ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জয় ঘোষণার মাস, মে মাস ফ্রান্সের উত্তাল ছাত্র আন্দোলনের মাস, মে মাস নকশালবাড়ির কৃষক নারীর রুখে দাঁড়ানোর মাস, মে মাস নাকবা-কে মনে রেখে ফিলিস্তিনের লড়াইয়ের শক্তিকে সংহত করার মাস, মে মাস প্যারি কমিউনের শ্রমিক নারীর মাটি কামড়ে শেষ লড়াইয়ের মাস। এই মে-মাসে বামা-র পাতা সেজে ওঠার কথা ছিল শ্রমের আখ্যানে, লড়াইয়ের গল্পে, দ্রোহের উদযাপনে, প্রতিরোধের উৎসবে।
অথচ, এই মাস হয়ে উঠল আমাদের সমষ্টিগত শোকযাপনের মাস, মৃত্যুর মাস, তীব্র আশঙ্কা আর উদ্বেগের মাস।
গত এক মাস ধরে দেশজুড়ে মৃত্যু মিছিল; শহরে শহরে জ্বলল গণচিতা, খোঁড়া হল গণকবর, পার্ক হয়ে উঠল অস্থায়ী শ্মশান। আমরা আমাদের সহনাগরিকদের শব ভেসে যেতে দেখলাম নদীর জলে। শুধুমাত্র অক্সিজেনের অভাবে, ন্যূনতম স্বাস্থ্য পরিষেবা না পেয়ে দেশজুড়ে মৃত্যু হল হাজার হাজার মানুষের। আমরা হারালাম আমাদের স্বজন, বন্ধু, আর কমরেডদের।
এর পাশাপাশিই আমরা দেখলাম এক নিষ্ঠুর নির্লিপ্তি। এই প্রবল সংকটের সময়ে কার্যত উধাও হয়ে গেল দেশের সরকার। দেশজুড়ে যখন অক্সিজেনের হাহাকার, হাসপাতালের একটা বেড-এর জন্য হন্যে হয়ে পথে পথে ঘুরে মরছেন রোগী ও তার পরিজনরা, ন্যূনতম চিকিৎসা পরিষেবা হয়ে উঠছে মহার্ঘ, চলছে বেলাগাম কালোবাজারি, সেই সময়ে অবস্থার উন্নতিতে বিন্দুমাত্র উদ্যোগও নেওয়া হল না সরকারের তরফে। বরং অতিমারী প্রতিরোধের অন্যতম মূল হাতিয়ার প্রতিষেধক ছেড়ে দেওয়া হল খোলা বাজারে। একদিকে যখন হাসপাতালগুলিতে স্বাস্থ্যকর্মীরা সামান্য অক্সিজেনের জন্য অসহায় আবেদন জানিয়ে ব্যর্থ হচ্ছেন বার বার,অক্সিজেনের অভাবে হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হচ্ছে রোগীর, তখন রাজধানী শহর দিল্লিতে চলল দর্শকহীন আইপিএল-এর নির্মম প্রদর্শনী। অতিমারী রোখার জন্য আবারও রাজ্যে রাজ্যে বেছে নেওয়া হল সেই লকডাউনকেই।
গত এক বছরেরও বেশি সময়ে ধরে চলা কোভিড অতিমারী বর্তমান পৃথিবীর নয়া উদারনৈতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অন্তঃসারশূন্যতাকে ন্যাংটো করে দিয়েছে বিশ্ব জুড়ে। পৃথিবীর তাবড় শক্তিধর দেশগুলি হিমশিম খেয়েছে পরিস্থিতি সামাল দিতে। মৃত্যু হয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষের। এই অতিমারী সংকট দেখিয়েছে চিকিৎসা পরিষেবার মতো প্রাথমিক অধিকারকে বাজারে বেচে দেওয়ার ফল কী হতে পারে।
উন্নত পুঁজিবাদের দেশগুলি, পুঁজির স্বার্থেই বিনামূল্যে টিকা, লকডাউনের ক্ষতিপূরণ স্বরূপ ভাতা, ঋণ ইত্যাদির ব্যবস্থা করে পরিস্থিতিতে খানিক জোড়াতালি লাগানোর চেষ্টা করেছে ঠিকই কিন্তু বিশ্বজুড়েই বেড়েছে বেকারত্ব, অনাহার আর মৃত্যু। আর এই সংকটের ভার বইতে হয়েছে ক্ষমতা কাঠামোর নিচের তলায় থাকা মানুষদের। আনুপাতিক হারের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে কাজ হারিয়েছেন মেয়েরা, কাজ হারিয়েছেন প্রান্তিক বর্ণ ও জাতির মানুষ।
এরই মধ্যে ভারতে ক্ষমতায় থাকা সরকার সেই সংকটকে নিয়ে গেছে এক অন্য উচ্চতায়। ইতিহাস আমাদের সময়কে পড়বে এক নিষ্ঠুর ঘাতক সময় হিসেবে; দেখবে সংকটকালীন সময়ে, ফ্যাসিবাদী, খুনে, বিজ্ঞানবিরোধী, উন্নাসিক একটি দল রাষ্ট্রের ক্ষমতায় থাকলে মানুষের জীবন ঠিক কতটা সস্তা হয়ে ওঠে।
করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গ অবশ্যম্ভাবী জেনেও স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর উন্নতিতে কোনওরকম নজর না দিয়ে সরকার মেতে থেকেছে তার জনবিরোধী নীতিকে বাস্তবায়িত করার পরিকল্পনায়, সংকটকে ব্যবহার করেছে শাসকশ্রেণির স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে। প্রতিষেধক তৈরিতে ব্যয় না করে সরকারি কোষাগারের টাকা ঢালা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর সাধের সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রকল্পে, গরু গোবরের গবেষণায়।
ভারতের মতো দেশ যেখানে মোট কর্মীসংখ্যার ৯০ শতাংশেরও বেশি মানুষ কাজ করেন অসংগঠিত ক্ষেত্রে, এক তৃতীয়াংশ মানুষের আয় রোজের হিসেবে, ৬০ শতাংশ মানুষের বাস দারিদ্র্য সীমার নীচে সেখানে লকডাউন যে গণহত্যারই সামিল, গত এক বছরের ভারতের দিকে তাকালেই তা স্পষ্ট হয়ে যায়। অথচ লকডাউন এড়িয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলার সুযোগকে কাজে লাগানোর কোনও চেষ্টাই করা হয়নি এই দেশে। ধুঁকতে থাকা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর লকডাউন চাপিয়ে দিয়েই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা চলছে বিভিন্ন রাজ্যে। ভারতের বাস্তবতাকে মাথায় রেখে সংকট মোকাবিলার ব্লু-প্রিন্ট তৈরির চেষ্টা করেনি কোনও দলই। দেশের ধনকুবেরদের ওপর আপতকালীন ভিত্তিতে কর লাগু করে লকডাউনের সংকটকে লাঘব করার দাবী তোলেনি একটিও সংসদীয় দল।
এরই মধ্যে রাজ্যে রাজ্যে চলেছে ভোট উৎসব। কিন্তু অতিমারীর সময়ে হওয়া এই ভোটেও জনস্বাস্থ্য ভোটের ইস্যু হয়ে ওঠেনি, মাত্র ক’মাস আগে লক্ষ লক্ষ শ্রমজীবী মানুষের মাইলের পর মাইল হেঁটে ঘরে ফেরা নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি কোনও দল। ভারতের সংসদীয় ব্যবস্থায় শ্রমিক শ্রেণির স্বরের অনুপস্থিতি স্পষ্ট হয়ে গেছে আরও একবার।
ইতিহাস বলে, যেকোনও সংকটেই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন সমাজের প্রান্তে থাকা মানুষরা; কোভিড ও তৎজনিত লকডাউনেও তার অন্যথা হয়নি স্বাভাবিকভাবেই। একদিকে যখন শ্রমজীবী মানুষ, ভারতে যাদের অধিকাংশেরই জাতিগত পরিচয়ে দলিত, মুখোমুখি হয়েছেন এক অভূতপূর্ব বিপদের, সেই বিপদ দ্বিগুণ হয়ে দেখা দিয়েছে সেই সব মানুষদের জন্য, শ্রেণি ও জাতিগত পরিচয়ের সঙ্গে সঙ্গেই লিঙ্গ পরিচয়ের নিরিখেও যাদের প্রান্তে অবস্থান।
লকডাউন-এর মতো ব্যবস্থা, বহু বছরের লড়াইয়ের অর্জন মেয়েদের বাইরের জগতে চলাচলের অধিকারকে কেড়ে নিয়েছে এক লহমায়, কর্মী সংকোচনের প্রথম কোপ পড়েছে অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করা লক্ষ লক্ষ শ্রমিক নারীর ওপর। স্বাস্থ্য পরিষেবা ক্ষেত্রে পৃথিবী জুড়েই নার্স ও নিচু তলার স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে মহিলাদের সংখ্যাধিক্য। এই অতিমারীর সময়ে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যেতে হচ্ছে এই বিপুল সংখ্যক মানুষকে। বছরভর অনলাইন শিক্ষায় স্কুলছুট হচ্ছে হাজার হাজার শিশু, আর সেখানেও প্রথম কোপটা বাড়ির মেয়েটার ওপর পড়াই রীতি।
গত বছররে লকডাউনের অভিজ্ঞতা দেখিয়ে দিয়েছে লকডাউন-এর সঙ্গে সমানুপাতিকভাবে বাড়ে গৃহহিংসার ঘটনা। এবছরও যে তার অন্যথা হবে না সেকথা বুঝতে কোনও রকেট সায়েন্স জানার দরকার পড়ে না। প্রান্তিক লিঙ্গ পরিচয়ের মানুষ, যাদের শুধুমাত্র লিঙ্গ ও যৌনতার পছন্দের কারণে হেনস্থা হতে হয় ঘরে বাইরে, এই লকডাউনের সময়ে পরিবারের সঙ্গে বন্দী হয়ে থাকা তাদের জন্য শাস্তিরই সামিল। অথচ লকডাউনের সিদ্ধান্ত যখন নেওয়া হল, এই কোনও সমস্যারই সমাধানের কোনও উপায় রাখা হল না। তৈরি হল না কোনও হেল্প লাইন বা সেফ হোম।
কোভিড সংকটকালের শুরুর সময়ে থেকে, বিশ্ব জুড়ে নারীবাদীরা বলে এসেছেন সরকার যদি হস্তক্ষেপ না করে, যদি না কোনও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকে সরকারের তরফে তাহলে কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গ সাম্যের ক্ষেত্রে যতটুকু এগোনো গেছে তা পিছিয়ে যাবে কয়েক দশক, অন্ততঃ পঞ্চাশ বছর পিছিয়ে থেকে শুরু করতে হবে লড়াই। আর ভারতের মতো দেশ যেখানে লড়াইটা শুরুই হয় পিছিয়ে থেকে, সেখানে যে মেয়েদের অবস্থা আরও সঙ্গীন হবে সেকথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
কিন্তু, যে রাষ্ট্র অতিমারীকালীন সংকটে দেশের মানুষকে অক্সিজেন দিতে পারে না, নিশ্চিত করতে পারে না ন্যূনতম স্বাস্থ্য পরিষেবা, যে রাষ্ট্র মহামারীর সময়ে জনসাধারণকে বিনামূল্যে প্রতিষেধক দিতে অস্বীকার করে, লাঠির ডগায় শাসন করে বিপন্ন জনগণকে, যে দেশে অতিমারী সংকটকে হাতিয়ার করে খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া হয়, যে দেশ মানুষের কাছে দুটো মাত্র বিকল্প খোলা রাখে- হয় সংক্রমণ নয় অনাহার, সেই দেশে দাঁড়িয়ে মেয়েদের জন্য বিশেষ ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা আকাশ কুসুম কল্পনাই মনে হয় বটে, সেই দাবিও ওঠে না কোথাও।
আর এই দাবি না ওঠা, সংকটকালীন নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে লিঙ্গ অসাম্যের প্রশ্নকে নাকচ করে দেওয়া আরও একবার মনে করিয়ে দেয় নারীর অধিকারের প্রশ্ন, প্রান্তিক লিঙ্গের মানুষের অধিকারের প্রশ্ন গৌণ হয়েই রয়ে গেছে, মনে করিয়ে দেয় কেন শ্রেণির রাজনীতি আর লিঙ্গ রাজনীতি পরস্পরের পরিপূরক, কেন একটি সাম্যের প্রশ্নকে অস্বীকার করে অন্য সাম্যের পৃথিবীতে পৌঁছনো সম্ভব নয়। মনে করিয়ে দেয়, প্যারি কমিউনেের ‘পেত্রোলিউজ’-দের প্রতিরোধ, হে-মার্কেট জমায়েতের শ্রমিকের সংগ্রাম, লালফৌজের ‘নাইট-উইচ’-দের নাৎসি বাহিনীকে উৎখাত করার লড়াই, সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ব্যবস্থা বদলের আকাঙ্ক্ষা, নকশালবাড়ির ধনেশ্বরী, মুরুবালা, ফুলমতিদের রুখে দাঁড়ানো স্পর্ধা, ফিলিস্তিনের মাথা না নোয়ানোর অদম্য জেদ একই সুতোয় গাঁথা।
তাই এই কঠিন সময়ে, পেত্রোলিউজ ও নাইট উইচ-দের উত্তরাধিকারকে আগলে, প্রতিস্পর্ধার লড়াইয়ের সংহতিতে থাকার অঙ্গীকার নিয়ে, সাম্যের পৃথিবীর আকাঙ্ক্ষায়, আগামীর স্বপ্ন চোখে নিয়েই প্রকাশিত হল বামা-র প্রথম বর্ষ, তৃতীয় সংখ্যা।