শেষ কৃত্যের অনুষ্ঠান তখন জোরতালে চলছে – উঠোনের এক কোণে এবড়ো খেবড়ো করে কাটা কাঠের উপর একটি বড় তামার পাত্রে জল গরম হচ্ছে, আরেক কোণে মোঘেল আরেকটি জলপাত্রে গোলাপ জল মেশাচ্ছে। পেশাদার রাঁধুনির সহকারীরা নিচের তলার রান্নাঘরের একাংশ জুড়ে খাবার আর নুন চা বানাচ্ছে শোকার্তদের জন্য। প্রতিবেশীরা পাথুরে উঠোন পরিষ্কার করে রেখেছে কফিনের পাশে জড়ো হওয়া শববাহকদের জন্য।
মা আমাকে উপরে গিয়ে আমার ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বইগুলো গুছিয়ে রাখতে বলল, যাতে শোকাহত অতিথিদের জন্য জায়গা করা যায়। কিছু নিকট আত্মীয়রা হয়তো রাতে থেকে যাবেন। সন্ধ্যে থেকে ভোর অবধি আবার কার্ফিউ জারি করেছে। উপরে বড় ঘরে গেলাম। একটা সুসজ্জিত কাঠের উরুসু1 দিয়ে ঘরটা চার ভাগ করা। সেই ঘরটায় গেলাম যেখানে বোবে ঘুমত। বোবের কম্বল আর তোশক তুলে রেখে পাশের কামরায় আমারটা তুলতে গেলাম। জানলার ধারে রাখা বইগুলো তুলে আলমারিতে গুছিয়ে রাখলাম। ১৯৯৪-এর গ্রীষ্মে, এই আলমারির পাল্লার গায়ে, স্কুল থেকে চুরি করে আনা একটা টিল চক দিয়ে কয়েক লাইন লিখে রেখেছিলাম।
কীভাবে ১৫ই আগস্ট উদযাপন করেছিলাম
পেটে বিষ নিয়ে
শুয়ে
গর্তের মধ্যে
কোনওমতে
মরিয়া হয়ে
ওষুধ কিনতে গিয়েছিলাম
সরু গলি দিয়ে
কাঁটাতার দিয়ে
রাস্তা কাটা
বিষাক্ত কার্ফিউ
যা সবাইকে গেলানো হয়, জোর করে
ফোলা চোখে, ফাটা ঠোঁটে
দেখি আর পড়ি
শাটারে লেখা গ্র্যাফিটি
আজাদি
১৯৯৪-এর আগস্টেই বুঝি কার্ফিউ আর বিষে কত মিল। সেই গ্রীষ্মে ওরা আমার জীবন দখল করেছিল। আমাকে বন্দী রেখেছিল। দিনটা শুরুই হয়েছিল খিদেয়। ফ্রিজের দরজা খুলে বরফে-জমা গোস্তাব2 দেখেই জিভে জল এসে গেছিল। একটু গললেই, মাংসের বল গুলো প্রথমে দুভাগে দুটো আধা চাঁদ করে কেটে আবার দুভাগে কেটে আটটা ভাগ করলাম। মিনিটের মধ্যে মুচমুচে করে ভেজে পালিশ করে নিলাম। বোবে চিরকাল ঘন দই দিয়ে গোস্তাব পরিবেশন করত। আমি সেটা বাদ দিয়েছিলাম, সেটাই হয়তো আমার ভুল ছিল।
যে গোস্তাবটা আমি খেয়েছিলেম সেটা এক প্রতিবেশীর বিয়েতে হয়েছিল। একদিক দিয়ে ওটা খুবই দামি। ১৯৯৪-এ ওয়াজয়ান, অর্থাৎ, আমাদের ঐতিহ্যবাহী নানা পদের খাবার প্রায় দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠছিল। বিয়ের অনুষ্ঠানই তো কেটে ছেঁটে দেওয়া হয়েছিল, অতিথির তালিকাতেও শুধু ঘনিষ্ঠ মানুষদেরই ঠাঁই হচ্ছিল। অনেক কম অনুষ্ঠানে সেরে ফেলা হত, সূর্যাস্তের পর কোনও আচার-অনুষ্ঠান থাকত না। অনেকটা পণ্ডিতদের সংস্কৃতিতে যেমন। আমি শুধু একটাই দিনের বেলার বিয়েবাড়িতে গেছিলাম। আমাদের শিক্ষক গোপীনাথ কাউল, ওরফে, আমাদের মাস্টারজির নাতনির বিয়েতে। সেটা ছিল ১৯৮৮। তখন মুসলিম বিয়ে সন্ধ্যে থেকে শুরু হয়ে সারা রাত চলত। ১৯৯০-এর পর সন্ধ্যে থেকে ভোর কার্ফিউ আর রাত দুপুরে সেনাদের রেইডের ফলে সন্ধ্যের পর আর ওসব কিছু করা সম্ভব ছিল না। দিনের বেলার অনুষ্ঠানেও লোকে একদম এড়াতে না পারলে তবেই যেত। যেমন নিকট আত্মীয় বা প্রতিবেশীর বাড়িতে বিয়ে বা কোনও অনুষ্ঠান।
পারায় সেরকমই একটা অনুষ্ঠানে মা সেদিন দু’ঘন্টার জন্য গিয়েছিল। সাধারণত ওরকম সময়ে অতিথিদের কাওয়ে3, শিরমল4, খাটাই5 আর শুকনো ফল6 দেওয়া হয়। এরপর আসল খাওয়া দাওয়া। নানারকমের পদ। খাওয়া চলত তিন-চার ঘন্টা ধরে। সেই সব দিন আর নেই। সব শেষ।
আগস্টের মাঝামাঝি। তাই বেশ গরম। এরকম গরমের সময় এমনিই খিদে কম লাগে… মায়েরও তাই বিয়েবাড়িতে খুব একটা খাওয়া হয়নি। তাছাড়াও বিয়েবাড়িতে অতিথিদের জন্য প্লাস্টিকের ব্যাগে খাবার প্যাক করে দেওয়ার চল ছিল। তাই মা গোস্তাবা আর কিছু কাবাব নিয়ে ফেরে। সেই দিন রাতেই আমরা কাবাব খেয়ে নিয়েছিলাম। আখরোট আর দই দিয়ে রামজান কাকের বানানো একটা চাটনির সাথে। কিমাটা মা রেখে দিয়েছিল পরে বানানোর জন্য। হয়তো ভুলেই গেছিল ওটার কথা। অন্তত যতক্ষণ না আমি খেয়ে ফেললাম!
এই লুকিয়ে এলাহি আহারের পর আমার খুব অলস লাগতে শুরু করলো। ঝিমুনি এসে কখন যে গভীর ঘুম এসে গেল! ঘুম ভাঙলে দেখি বিছানা ছেড়ে আর উঠতে পারছি না। পরে বোধহয় বোবে আমাকে পায়েস খাওয়ানোর চেষ্টা করছিল। তখনও আমি ঘুমে আচ্ছন্ন। বসে গলা দিয়ে খাবার নামানোর মতও শক্তি ছিল না।
সারা রাত যন্ত্রণায় কাটলো। মা মাঝেমধ্যে দালচিন কাওয়ে7 খাওয়াতে থাকছিল। সলিড কিছু খাওয়ানোর চেষ্টা করেনি। না তো বমি হয়ে বিষটা বেরোচ্ছিল, না ফ্লাশ হল।
১৫ই আগস্ট ঘুম ভাঙলো ফোলা মুখ নিয়ে। বোবে গুল্কান্দ বানিয়েছিল। হাল্কা গা গুলানি থাকলেও সেটা খেলাম। ততক্ষণে পেটের ইনফেকশন এতটাই খারাপ দিকে গেছে যে বাড়ির পথ্য আর কাজে আসছে না। চিকিৎসার অভাবে ক্রমে আরো খারাপের দিকে যাচ্ছিল। সন্ধ্যের দিকে চোখের পাতাও এতটাই ফুলে গেছিল যে চোখ খোলা দুষ্কর হয়ে উঠেছিল। কখনও সখনও আধ বোজা চোখে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছিলাম। মুখ চোখ ফুলে থাকা সত্ত্বেও আরো খারাপের আশঙ্কা করে ওই অবস্থাতেই মায়ের সঙ্গে বেরোলাম। কাছাকাছি এক ওষুধের দোকানির বাড়ি থেকে যদি কিছু ওষুধ আনা যায়। অন্তত পরের দিন কার্ফিউ ওঠা অবধি যদি ক্ষণিকের স্বস্তিও মেলে। কার্ফিউ উঠলে না হয় ডাক্তার দেখানো যাবে।
সমস্ত দোকান বন্ধ। খাঁ খাঁ করছে রাস্তা। প্রতি অলিতে গলিতে একজন কি দুজন করে সেনা মজুত আছে। ১৫ই আগস্টে আমাদের উপর ‘নিষেধাজ্ঞা’ জারি রাখতে। এগিয়ে আর কোনো লাভ নেই। অকারণে ঝামেলা ঝক্কি করে কাঁটাতার দিয়ে হেঁটে গেলেও আবার সেই ফিরিয়েই দেবে। নিজের যন্ত্রণা বিদরিত ফোলা মুখ নিয়ে সেনাদের সামনে গিয়ে তাদের করুণার পাত্র হওয়ার কোনো ইচ্ছে ছিল না। আমাদের যেতে দেওয়া হবে কি হবেনা সবই তাদের হাতে, তাদের দয়া দাক্ষিণ্যে। নিজেকে সেই জায়গায় নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাতেই মন সায় দিচ্ছিল না তাই ফিরে এলাম। আরেক দিন অপেক্ষা ছাড়া আর কোনো উপায় রইল না। আরেকটা লম্বা দিনের কারাবাস। দিন শেষে অন্ধকার সন্ধ্যে। ভারতের স্বাধীনতা উদযাপনকে প্রত্যাখ্যান করে কাশ্মীর অন্ধকারে বাতি নিভিয়ে কাটায়। আর এই সবের মধ্যে আমি পেট আঁকড়ে ব্যাথায় গুমরে পড়ে থাকি। ঘুমোবার চেষ্টা করি। কিছু দিন পরেই আমি সুস্থ হয়ে উঠি। কিন্তু ওই দিনটা থেকে যায়। বিষাক্ত স্মৃতি হয়ে।