পুলিশি হেফাজত, পুলিশি সন্ত্রাস… রুনু গুহ নিয়োগীর ‘সাদা কালো’…
প্রায় ছয় মাস বাদে আমাকে আবার তদন্তের নামে তলব করেছিল। আমরা জানতাম, এর মানে হেফাজতে নিয়ে অত্যাচার করবে, আর কিছুই না। তখন আমাদের কেস-এর আর কোন তদন্ত বাকি থাকার কথা না। আমাদের থেকে আর কিছু খবর বের করার অবস্থাও নেই। জেলের বন্ধুরা আমাকে দুটো সায়া পরিয়ে মোটা শাড়ি জড়িয়ে দিয়েছিল যাতে মারলে কম লাগে। নোংরা, মলিন শাড়ি পরিয়ে দিত যাতে কোনওমতেই সুন্দর না দেখায়। রুনু নিয়োগীর সময় সত্যিই সাংঘাতিক ছিল। তখন এটাই চল ছিল। আমার ওপর যা হয়েছে অন্যদের উপর হওয়া অত্যাচারের তুলনায় তো তা কিছুই না।
রুণু গুহ নিয়গী অন্য রকমের সেডিস্ট ছিলেন। প্রচন্ড নির্মম। কথা বলতে বলতে কোন কারণ ছাড়াই আক্রমণ করতেন, মারধর করতেন। আমাদের প্রথম ছয় মাসেই সব হয়ে গেছিল, দুজন রাজসাক্ষী ছিল… কাজে কাজেই নতুন কিছু তথ্য পাওয়ার ছিল না। তবুও যে কোনও ছুতোয় অত্যাচার চালাত। ‘দেখেছিস ববির মত দাঁড়িয়েছে!’ তখন জেলে আমরা আর কী জানি কে ববি! কিন্তু এই ছুতোয় মারধর করত, সন্ত্রাস চালাত। আমাদের বাবা মায়েরা তখন চারিদিক থেকে সমর্থন জোটানোর চেষ্টা করছে। কবি সাহিত্যিক, সত্যজিত রায়ের মত মানুষেরা আমাদের মুক্তির দাবি করছেন… নানা অছিলায় নির্যাতন চলত। ভাবাও অপরাধ ছিল।
আমার দাদু বৈষ্ণব ছিলেন। “বৈষ্ণব বাড়ির মেয়ে হয়ে নকশাল করছে”– বলে উল্টো ঝুলিয়ে মেরেছিল আমায়। একটা সন্ত্রাসের বাতাবরণ তৈরি করে রাখত। ইন্টারোগেশন রুম-এ অপেক্ষা করতে করতে অন্যদের আর্তনাদ শুনতে পেতাম। দেখতাম কত মানুষ মাটিতে বসে প্রমাদ গুনছে। তারই মধ্যে সেই আধ মরা মানুষগুলোই আশ্বাস দিত, বলত আমরা আছি, আমরা জেগে আছি। আমাদের বিভিন্ন খবর এনে দিত। এই মানুষগুলোর এই অপরিসীম সাহস আমাদেরও রুখে দাঁড়াবার শক্তি যোগাত। মনে হত আমরাও পারব। আমরা ভেঙে পরবো না।
ওরা মারার সময় বলতো তোকে পাগল করে দেব, নগ্ন হয়ে দৌড়াবি। আসলে ওদের মূল লক্ষ্য ছিল আমাদের মনুষত্ব শেষ করে দেওয়া, আমাদের ভেতর থেকে গুঁড়িয়ে দেওয়া। তখন কোথাও গিয়ে মাথা ঠিক রাখা, কোথাও গিয়ে নিজের সত্ত্বা, নিজের সম্মান বাঁচিয়ে রাখাটাই প্রতিরোধ হয়ে উঠত।
একবার এত মেরেছিল যে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যেত হয়েছিল। প্রায় আধমরা হয়ে গেছিলাম। আমাকে এসএসকেএম নিয়ে গেছিল। তার মধ্যেই জিজ্ঞাসাবাদ চলছিল। সেই পুলিস হেফাজতের দিনগুলো সাংঘাতিক ছিল! তাও সেই সময়েও কত মানুষ কিভাবে কত ঝুঁকি নিয়ে সাহায্য করেছিল। এরা কেউ চুরির দায় অভিযুক্ত ছিল, কেউ অন্য কিছু… এই সমাজের লুম্পেন, বাতিল মানুষেরা, অথচ তারাই কি ভাবে পাশে দাঁড়িয়েছিল… তাদের জন্যই এত কিছু সহ্য করতে পেরেছিলাম। বেঁচে থাকাটাই সংগ্রাম ছিল। মুচলেকায় সই করব না, আপোস করব না, নিজেকে বলতাম আমি স্বেচ্ছায় এই রাজনীতিতে এসেছি, এদেরকে কিছুতেই সেই সততা, সেই বিশ্বাস ছিনিয়ে নিতে দেব না। এটাই আমার প্রতিরোধ ছিল – শারীরিক ভাবে আমাকে মেরে ফেলতে পারো, ভেঙে দুমড়ে মুচড়ে দিতে পারো, কিন্তু মানসিক ভাবে আমাকে কিচ্ছু করতে পারবে না। যাই কর, মাথা নোয়াব না। এটাই বেঁচে থাকার, টিকে থাকার সাহস দিত।
হেফাজতের বন্ধুরা…
সেই সময়ে প্রায়ই বিভিন্ন যৌন কর্মীরা গ্রেফতার হয়ে আসত। পুলিশি হেফাজতে থাকতেই তাদের সাথে আলাপ হয়েছিল। সেখানে কালী বলে একটি মেয়ে ছিল। খুব প্রাণোচ্ছল। হৈহৈ করত। আর ছিল এক নানি। কালীরা এসে আমাকে দেখে ভেবেছিল আমিও ওদের মত একই কারণে গ্রেফতার হয়েছি। আমি বৃথা চেষ্টা করতাম বোঝাতে আমি রাজনৈতিক বন্দী, নকশাল, নিপীড়িত মানুষদের, গরীব মানুষদের জন্য লড়তে গেছিলাম… ওরা ওসব বুঝতো না।
কালী একদম স্টার ছিল। বাকি মেয়েদের নেতা ছিল। কালী একদিন শুনছি গল্প করছে জানো তো সেই দিন দেখলাম কিছু জন এসে আক্রমণ করলো জেলে, চারিদিকে গুলি চলছে! খানিক বাদে বুঝলাম ও আমাদের কেসের কথাই বলছে, জেল ব্রেকের দিনের কথা… কিন্তু ওর মত করে! আমাদের তো অত কিছুই ছিল না, সিআরপি বরং পাগলের মত গুলি চালাচ্ছিল! কালী বলে যাচ্ছে, “আর তারপর একটা মেয়ে এলো লাল শাড়ি পরে, দুই হাতে পিস্তল নিয়ে গুলি চালাতে চালাতে!” আমি হতবাক হয়ে শুনছি আর বলছি, ‘কালী এরকম তো কিছু হয়নি!’ কালী থামিয়ে বলল, ‘আরে! তুমি কিছু জানো না!’ গল্প চলতে থাকলো, ‘তারপর একটা কালো আম্বাসেডার এলো…’ আমি আর ওর জমাটি গল্পটা নষ্ট করতে চাইনি! ও বলেছিল, আমি তোমাকে ছাড়াবার ব্যবস্থা করব ঠিক। আমি ততদিনে জানি কি কেস দিয়েছে, ছাড়ার সম্ভাবনা কতটা… তবু কালি দমবার নয়। তারপর একদিন এসে বলল, দিদি হবেনা, তোমাকে ছাড়বে না…’
নানি বড়বাজারে কাজ করত। লোকের বাড়ি কাজ করত সেখানে একটা সোনার চেন খোয়া গেছিল… নানির ওপর দোষ চেপেছিল… নানি বিহারের মানুষ। তিনি তো ভাবতেই পারতেন না ওরকম জায়গায় থাকতে হবে। তার ওপর কালী আর ওর বন্ধুদের দেখে যারপরনাই অবাক হয়েছিলেন। নানি তো ভাবতেই পারতেন না, আমার মত কেউ ওখানে কেন রয়েছে! একদিন আমার ওপর প্রচন্ড নির্মম অত্যাচার চালিয়েছিল পুলিশ। আমি ফিরে আসায় আমার চেহারা দেখে নানি শিউরে উঠেছিল। তারপর সারারাত আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার সেবা করেছিল। নানি বলত আমাদের জেলে নিয়ে গেলে আমরা একসাথে থাকব। কিন্তু আমি কিছুতেই বোঝাতে পারতাম না যে আমাকে ওনার সাথে রাখবে না। জেলে নানি মাঝে মাঝে সেলের পেছনে এসে কথা বলত। নানি যেদিন ছাড়া পেল, আমাকে এসে বলছিল আমাকে ক্ষমা করে দিও, তোমাকে ছেড়ে যেতে হচ্ছে। আমি তো খুব খুশি হয়েছিলাম যে নানি ছাড়া পাচ্ছে, কিন্তু নানি খুব অপরাধী মুখে ক্ষমা চাইছিল। এই রকম মানুষ, এই ভালোবাসা এই গুলোই বাঁচিয়ে রেখেছিল আমাদের… নানি ওই দিন না থাকলে আমি হয়তো মরেই যেতাম…
এত নির্মমতা, নিষ্ঠুরতার মধ্যেও কেউ কেউ জীবন হাতে সংহতির বার্তা রেখে যেত…
পুলিশি হেফাজতে থাকার সময়ে যখন দিনের পর দিন অত্যাচার চলছে, তখন এই ধরনের বিভিন্ন মানুষদের পাশে থাকা আর কমরেডদের একটা ‘আমরা জেগে আছি, আমরা পাশে আছি’ বার্তা, সব কিছু সহ্য করার শক্তি দিত। কেউ এসে লুকিয়ে নুন দিয়ে যেত। সেটাই অনেক ছিল। একটু নুন পেলে তাই দিয়ে মুখ ধোয়া যেত, নিজেকে পরিষ্কার রাখা যেত। রাষ্ট্র যখন তার সমস্ত দাঁত নখ দিয়ে তোমাকে তিলে তিলে শেষ করে দিতে চাইছে, তখন এই ছোট ছোট জিনিসগুলো, নিজেকে ভালো রাখা, এগুললোই প্রতিরোধ হয়ে উঠত। সেই নুনটা খুঁজে পেলে তোমাকে সেটার জন্যই মেরে ফেলতে পারে। তাই বাথরুমে এক খাঁজে লুকিয়ে রাখতে হত।
একদিন আমাদের একজন কোর্টে গিয়ে স্লোগান দিয়েছিল। তাই মার শুরু হল। সেই দিন রাগে ফুঁসছিলাম। কিন্তু জোর করে খেতে হত। কারণ ওদের ভয় ছিল যদি মরে যাই। খেতে ইচ্ছে করত না, রাগে যন্ত্রণায় গলা দিয়ে খাবার নামত না। তাও জোর করে খাওয়াত। সেই দিন সবাই ঘুমিয়ে গেছে, আমার খাবার রেখে গেছে। খাবারটা তুলে দেখি কেউ আমার রুটিতে চিনি মাখিয়ে রেখেছে। কেউ নিজের জীবন বিপন্ন করে ওই চিনিটা মাখিয়ে গেছে। ওই দেখেই আমি ভয় খেতে শুরু করলাম। কারণ ওই চিনির কথা জানতে পারলেই যে দিয়েছে তাকেও শেষ করে দেবে! সমস্তটা গিলে নিয়েছিলাম যাতে এক দানাও পরে না থাকে। কান্না পেয়ে গেছিল।
জেলে অনেক কিছু দেখেছি, কিছু কমরেডদের রাষ্ট্রের কাছে বিকিয়ে যাওয়াও দেখেছি, বিশ্বাসঘাতকতা দেখেছি। তবে আমার কখনো মনে হয়নি চার বছর নষ্ট হয়েছে। এই চার বছরে অনেক কিছু শিখেছি। একটা যৌথতাও ছিল। লুকিয়ে চা বানাতাম। অনেক গভীর বন্ধুত্ব হয়েছে। মীনাক্ষীর সাথে খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়েছিল। আমরা একসাথে ঢুকেছিলাম, এক সাথেই বেরিয়েছিলাম। আমাদের ইন্টার্ভিউ একসাথে হত, কোর্ট ডেট এক সাথে ছিল। সব যে মত মিলত তা নয়। কিন্তু গভীর বন্ধুত্ব ছিল। কল্পনার সাথেও খুব ভালো বন্ধুত্ব ছিল। তারপর কৃষ্ণা, মাসিমা, মলয়াদি, অর্চনাদি। মলয়াদি, অর্চনাদি-দের অকথ্য অত্যাচার করেছিল। অদ্ভুত অনুভূতি হত। এক দিকে রুনু গুহ নিয়োগীর মত মানুষ যারা ক্ষমতার আস্ফালন করতে, ক্ষমতার কাছে বিকিয়ে গিয়ে নিজেদের মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিয়েছে। অপর দিকে, সেই সব মানুষ যারা এই ‘ভদ্র’ সমাজের চোখে বাতিল, যারা ‘ইতর’, এই নিষ্ঠুর অমানবিক ব্যবস্থার মধ্যেও যারা লড়ছে, ভালোবাসছে, একে অপরের পাশে দাঁড়াচ্ছে, সেই মানুষগুলোর সংহতি, সেই মানুষগুলোর প্রতিরোধ আমাদের বাঁচিয়ে রাখত। এই সমস্ত অনাচারের বিরুদ্ধে যুঝতে সাহায্য করত। এগুলোই বেঁচে থাকার সম্বল ছিল।