আচ্ছা, আচার খেতে কেমন লাগে? অথবা ধরো কাসুন্দি দিয়ে কাঁচা আম মাখা? আবার কালো নুন দিয়ে আমড়া, কামরাঙা, পেয়ারা, জলপাই? আমলকী, হ্যাঁ আমলকী কেমন লাগে? চিবিয়ে খাওয়ার পর জল খেলে কেমন ম্যাজিক হয় না? কী মিষ্টি!!!
আমাদের ছোটবেলায়, মানে অনেক অনেক আগে, ইস্কুলের সামনে এসব পাওয়া যেত। আমার এর মধ্যে সবচেয়ে ভালো লাগত কালো আমসত্ত্ব, বিট নুন মাখিয়ে। মা বলত ওগুলো পচা আম দিয়ে বানায় তাই খেতে নেই। মিছে কথা! যাতে বাইরের খাবার না খাই তাই সব বানিয়ে বানিয়ে বলত, আমি নিশ্চিত। তা সেরকম সময়ের একটা গল্প বলছি তোমাদের, পোষা খাবারের গল্প। আসলে গল্প না, সত্যি। আমার বন্ধু কমলার কথা।
ওর বয়স তখন কত হবে মনে নেই। আমার সঙ্গে ইস্কুলে পড়ত, ক্লাস টু। তা কমলা খুবই এসব খেতে টেতে ভালবাসত আরকি। আমারই মত। আমাদের ইস্কুলের সামনে সুলেমান কাকু আমড়া বিক্রি করত। শাপলা ফুলের মত কেটে, নুন ছড়িয়ে, একটা কাঠিতে গেঁথে দিত। আর সঙ্গে থাকত আচার, আমসত্ত্ব ইত্যাদি। এবারে ক্লাস টু, বুঝতেই পারছ আমাদের হাতে টাকা থাকত না। মায়ের কাছেই চাইতে হত। ওদিকে পচা আমের গল্প দিয়ে আমসত্ত্ব তো কিনে দিত না, আমড়াটা মাঝে মাঝে জুটে যেত। কমলারও তাই। ওর মা’ও ফলে না করত না। ভিটামিন সি, বুঝলে তো!
তা একদিন কমলা একটা শাপলার মত দেখতে আমড়া নিয়ে ক্লাসে এসেছে। আমরা এতে বেশ অবাকই হয়েছিলাম। এ তো ইস্কুল শেষ হলে পাওয়া যায়, ও ব্যাটা শুরুতেই বাগিয়েছে! আমাদের ইস্কুল শুরু হত ভোর বেলা, অত সকালে তো সুলেমান কাকুও দোকান খোলে না। ও পেল কথা থেকে এই আমড়া?
ক্লাসের জনা দশেক কমলাকে ঘিরে ধরল। প্রশ্নের পর প্রশ্ন। কোথায় পেলি? এত সকালে মা কিনে দিল? দিদিমণি এলে কী বলবি? খাচ্ছিস না কেন? আমড়াটা কি টক, নাকি মিষ্টি, নাকি পানসে? তো কমলা কোন উত্তরই দেয় না, খালি মুচকি মুচকি হাসে। ওদিকে ক্লাস শুরু হতে আর দশ মিনিট। বাকিরা হাল ছেড়ে দিয়ে নিজের নিজের বেঞ্চিতে গিয়ে বসল। ওদিকে কমলা তার আমড়া ধরেই আছে, খায় আর না। আমরা সবাই ভাবি, থাক তবে হাতে নিয়ে। খাবি বকা দিদিমণির কাছে। এসবই এদিক-ওদিক ভাবছি, হল্লা করছি, হাসি তামাশা করছি এর মধ্যেই দিদিমণি এসে হাজির। ক্লাস টিচার। খুউউব কড়া। গেল মাসে পুজোর ছুটির পর হাতে নেল পালিশ পরে এসেছিলাম বলে কী বকাই খেয়েছিলাম। সবাই ভয় পায় দিদিমণিকে। রেগে গেলে আর রক্ষে নেই। সেই দিদিমণির ক্লাসে কিনা কমলা হাতে আমড়া কাঠি নিয়ে বসে আছে? প্রথমে একটু মন খারাপ হল ওর জন্য, তারপর ভাবলাম থাক, খাক বকা। এমন ভাব করছে যেন হাতে চাঁদ পেয়েছে। বুঝবে ঠ্যালা।
দিদিমণি ক্লাসে ঢুকে অবশ্য প্রথমে কমলা আর ওর আমড়া দেখতে পায়নি। রোল কল করতে গিয়েই প্রথমে চোখ পড়ল। আর নজরে পড়তেই দিদিমণি কেমন যেন অবাক আর রাগ মেশানো চোখ করে ধমক দিয়ে বলে উঠলেন – “কমলা, তোমার হাতে ওটা কী”?
– আমার পোষা আমড়া, দিদিমণি।
– মানে? ঠাট্টা হচ্ছে? আমড়া কারও পোষা হয়?
– হয় তো! ওর নাম কিটি। আমার দিদির একটা বেড়াল আছে, তার নাম আমড়া। ও আমার সঙ্গেই আজ ক্লাস করবে দিদিমণি। কাঁচা আমড়া তো বেশিক্ষণ বাঁচে না…কালই হয়ত খেয়ে ফেলতে হবে।
ওর কথা শুনে দিদিমণি তো দূর, আমরাই হকচকিয়ে গেলাম। বলে কী মেয়েটা। পোষা আমড়া? নাম কিটি? আবার কাল খেয়েও ফেলবে? নিশ্চয়ই কাল মায়ের কাছে এমন মার খেয়েছে যে মাথার ঘিলু ওলটপালট হয়ে ঘন্ট পাকিয়ে গেছে। আমি দুষ্টুমি করলেই তো মা বলে, “এমন মার খাবি, মাথার ঘিলু নড়ে যাবে”। বেচারা কমলারও তাই হয়েছে হবে। মায়া হল।
ওদিকে দিদিমণি তো দমবার পাত্রী না। কমলা যত কথা বলে সে তত রেগে যায়। বলে “ফল কখনও পোষ্য হয়?” কমলা বলে, আলবাৎ হয়। “এই তো গেল পুজোয় আমি পেয়ারা পুষেছিলাম। কী ভালো খেতে হয়েছিল। তার আগে ছিল একটা আপেল। লাল টুকটুকে। চারদিন ছিল আমার সাথে। তাহলে আমড়া কেন হবে না?”
দিদিমণির ততক্ষণে ভিরমি খাবার অবস্থা। এত দাপট যার, সে কিনা এইটুকু মেয়ের কাছে কাবু হয়ে যাচ্ছে? তাও গলা খাকরে, নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, “ফল খাবার জিনিস কমলা, আর পোষ্য হয় প্রাণী। তুমি কী তোমার আমড়ার সঙ্গে খেলতে পারো? ফল তো খেয়ে ফেলার জিনিস। ওটা তুমি খেয়ে ফেলো। আর মা কে বোলো তোমাকেও নিশ্চয়ই দিদির মত একটা বেড়াল এনে দেবে। বা, দিদির বেড়ালটার সঙ্গেই না হয় খেলবে”।
– ও হবে না দিদিমণি। দিদির বেড়ালটা বড়ই পাজি। আদর করতে গেলেই আঁচড়ে দেয়। মা আমাকে আরেকটা বেড়ালও দেবে না। বলেছে, আগে বাড়িরটার সঙ্গে ভাব করতে, পরে ভেবে দেখবে। কী জানো তো, ফলই ভালো পোষ্য। খারাপ হবার আগে শুধু খেয়ে নিলেই হল।
এবার মনে হল দিদিমণি কিছু একটা ভেবে বার করেছে। বলল – “কিন্তু নিজের পোষা কাউকে কী কেউ খেয়ে ফেলে? ও তো আদরের জিনিস”। কিন্তু কমলাকে টলানো সম্ভব না। তার মতে পাজি বেড়ালের চাইতে সুস্বাদু আমড়াই ভালো। কিন্তু যতক্ষণ এটাকে খাবার সময় না হচ্ছে, সেটা নাকি হাতে নিয়েই বসে থাকতে হবে। তা একথায় সেকথায় সেদিনের ক্লাস হল মাটি। ঘণ্টা পড়তেই দিদিমণি তড়িঘড়ি ক্লাস ছেড়ে চলে গেলেন। এবারে আমরা সবাই মিলে হামলে পড়লাম কমলার ওপর। ব্যাপার জমে উঠেছে যাকে বলে।
কিন্তু মেয়ে এমন দুষ্টু, দিদিমণির সঙ্গে অত কথা বলেও আমাদের সঙ্গে কোন কথা বলতে সে নারাজ। অনেক পিড়াপিড়ির পর অবশেষে আমার দিকে তাকিয়ে বলল – “কিটিকে একটু ধরবি? আমি বাথরুম যাব। বেড়াল হলে সঙ্গে নিয়ে যেতাম, কিন্তু আমড়া তো, নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না”। আমি তো যেন হাতে চাঁদ পেলাম। কমলার আমড়া, আমায় দায়িত্বে দিয়ে যাচ্ছে। চাট্টিখানি কথা! আমি প্রাণ দিয়ে হলেও একে রক্ষা করব।
এরপর আরো দুটো ক্লাস এমনভাবেই চলল। যে দিদিমণিই আসে, পড়া ভুলে কমলার আমড়া নিয়েই আলোচনা চলে, তর্ক চলে। ওদিকে দেখতে দেখতে টিফিন টাইম হয়ে গেছে। এখন তো না আছে দিদিমণি না আছে ক্লাসের নিয়ম। সেদিন প্রায় কেউ আর খেলতে যায় না, উঁচু ক্লাসের দু’একজন দিদিও এসে দেখে গেছে কমলার পোষা আমড়া। ধীরে ধীরে অনেকেই আহা বাহা করতে শুরু করেছে। ক্লাস ফাইভের এক দিদি বলল – “খাসা হয়েছে, এই না হলে আমড়া”। আমাদেরই ক্লাসের ক বিভাগের সূপর্ণা, বাবা ডাক্তার বলে যার অহংকারে মাটিতে পা পড়ে না সেও দেখি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে কমলার আমড়ার দিকে। ক্লাস থ্রী-র লিপি, একবার কিটিকে হাতে নেবার জন্য তো প্রায় হাতে পায়ে ধরতে লাগল কমলার। কিন্তু কমলা, ওই বাথরুমে যাবার সময়টা বাদ দিয়ে আর কারো হাতে তার আমড়া দেবে না। অনুরোধ করলেই বলে – “তা নিজে কিনে নাও না বাপু, আমার আমড়ায় লোভ দিচ্ছ কেন?”
সেদিন ইস্কুল থেকে ফেরার পথে সুলেমান কাকার দোকানে লোকের ভিড় লেগে গেছে যেন। যারা নাক উঁচু অহংকারী গোছের, বড় দোকান ছাড়া কিছুই খেতে চায় না, তারা অবধি মায়েদের কাছে বায়না ধরেছে আমড়া কিনে দিতে হবে বলে। এই সবকিছুর মধ্যে আমাদের কমলা দেখি গর্বিত ভাব করে মায়ের সাথে সাথে বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছে। পরের দিন অবশ্য সে আর আমড়া নিয়ে ক্লাসে আসেনি। জিজ্ঞাসা করায় বলেছিল – “ও তো আমি সেদিনই খেয়ে ফেলেছি। এখন আমার একটা নতুন পোষ্য হয়েছে। তেঁতুলের আচার। সব জোগাড়যন্ত্র হয়ে গেছে। আজ বাড়ি গিয়েই বানিয়ে ফেলব, তারপর চেটে চেটে খাব”।
আমি তো অবাক! মেয়ে বলে কী! পোষ্য কখনও বানানো যায়?
তোমরা নিশ্চয়ই কমলার মত খাবারকে পোষ্য বানাতে চাও না। আমিও না। আমার তিনটে পোষ্য আছে – কুকুর। তাদের নাম স্নবি, তিতির আর মিতির। ওদের গল্প পরে কখনও বলব। কিন্তু আজকের জন্য কমলার সেই চেটে খাবার মজার তেঁতুলের আচারের রেসিপিটা তোমাদের দিচ্ছি। বাড়িতে বড় কারো সাথে মিলে এটা বানিয়ো, কেমন? একা একা কিন্তু এক্কেবারে বানাতে যেও না। এই আচার রান্না করে বানাতে হয় তো তাই বড় কাউকে পাশে রাখাই ভালো, ওই ধরো ছোটমামা, মাসি, দাদা বা দিদি গোছের কাউকে। অবশ্যি তার আগে তেঁতুল যদি এমনি এমনি খেয়ে শেষ করে ফেলো তাহলে অন্য কথা।
তেঁতুলের আচার
১. ওই ধরো আড়াইশ গ্রামের মত তেঁতুল। বেশিও নিতে পারো কিন্তু প্রথমবার একটু কম করে বানানোই ভাল। স্বাদ ভালো হলে না হয় পড়ে বেশি করে হবে। ভালো করে জলে ধুয়ে নিতে হবে। চটকাবে না, তাহলেই গলতে শুরু করবে কিন্তু। শুধু ধুয়ে জল ফেলে দেবে, তারপর আধঘণ্টা পরিষ্কার খাবার জলে ভিজিয়ে রাখবে। দেখবে তেঁতুলের গায়ে শক্ত শক্ত শিরা হয়, সেগুলো ছাড়িয়ে দিতে পারো। আবার চাইলে রাখতেও পারো। আচার হয়ে গেলে ওগুলো মুখে ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে খেতেও মজা হয় বেশ।
২. এবারে আচারের মশলা – এই সময়ে বড়দের সাহায্য লাগবে। উনুনে শুকনো খোলায় কয়েকটা শুকনো মরিচ (আমি ঝাল খেতে পারি না বলে তিনটে দিই, তোমরা নিজের মত করে দিও, বীজ ফেলে দিলেও ঝাল কম হয়), এক চা চামচ গোটা ধনে, মৌরি, আর হাফ চামচ গোটা জিরে দিয়ে ভালো করে ভাজতে হবে। তবে নজর রাখতে হবে যাতে পুড়ে না যায় – তাহলেই তেতো হয়ে যাবে। ভাজা হলে এই সব মশলা একসাথে গুড়ো করে নিতে হবে। বাড়িতে মিক্সি, শিলনোড়া যা আছে তাই দিয়েই হবে। নিজে করতে চাইলে একটা খবরের কাগজে মশলাগুলো রেখে ওপরে আরেকটা কাগজ চাপা দিয়ে রুটি বানানোর বেলনা দিয়ে গুড়ো করতে পারো। তবে মিহি করতে গেলে শিলনোড়াই ভালো আর শুকনো মরিচ হাতে চোখে লেগে গেলে মুখের থেকে চোখের জল বেশি পড়ে সেও এক ঝক্কি।
৩. এরপর গরম তেলে একটা শুকনো লঙ্কা আর এক চা চামচ পাঁচফোড়ন দিয়ে ভাল করে সেতলে জলসুদ্ধ তেঁতুল ওর মধ্যে ঢেলে দেবে। এরপর শুধু নাড়ার কাজ। ও হ্যাঁ, নুন দিতে ভুলো না। বেশ খানিকক্ষণ রান্না হলে আরেকটু জল মেশাবে তারপর সেই জলও কমে এলে গুড় অথবা চিনি দেবে। গুড় ধরো আড়াইশ গ্রাম মত। তবে পাটালী না। পাটালী এমনি খেতে ভালো হলেও এখানে আখের গুড় দেবে। এরপর অল্প আঁচে জল কমিয়ে শুকনো করে নেবে শুধু। ৫-৭ মিনিট লাগবে।
৪. জল একেবারে টেনে এলে, আগে যে মশলা ভেজে রেখেছিলে সেটা দিয়ে দেবে। তারপর অল্প আঁচে পুরোটা ভালো করে মিশিয়ে নামিয়ে নেবে।
৫. এরপর তো খাবার পালা। এ তো পেট ভরার খাবার না, মন ভরার খাবার। তাই যখন ইচ্ছে, একটু বিটনুন ছড়িয়ে চেটে চেটে খাও। তবে ভুলেও পোষা কুকুর অথবা বেড়ালটাকে খাওয়াতে যেও না কিন্তু।
চিত্রঋণ –
কভার ফটো ইউটিউব
স্কেচ – অনিন্দ্য সেনগুপ্ত