৩
ও ঠিক করেছে এবার থেকে কেউ ওকে ওর প্রিয় ফুল কী জিজ্ঞাসা করলে ক্লাসের বাকি মেয়েদের মতো গোলাপও বলবে না, পদ্মও বলবে না। তার বদলে বলবে জুঁই কিংবা শিউলি কিংবা চন্দ্রমল্লিকা। বেশ অন্যরকম হবে তাই না? যদিও ওর আসলে গোলাপটাই ভালো লাগে। ওইরকম ফুলের পাপড়ির মতো ঘের দেওয়া ফ্রক ওকে ওর বড় পিসি একটা কিনে দিয়েছিল। ওর একটু বড় হয়, আর ওকে মানায়ও না, পিসিই বলেছে। কিন্তু জন্মদিন হলে গরমের মধ্যে ঘামতে ঘামতেও ও ওই ফ্রকটাই পরে থাকে সারাদিন, কিছুতেই পাল্টায় না।
ওর সবেতে আসলে একটু বাড়াবাড়িটাই পছন্দ।
যেমন ওর মনে হয় পৃথিবীর সব ক্রীম দেওয়া কেক হওয়া উচিত দশতলা লম্বা যাতে মইয়ে চড়ে তবে উপরের চেরী ফলগুলোর নাগাল পাওয়া যায়। অন্ততপক্ষে এক পাড়া লোক খাবে, তবে না কেকের মতো কেক?
বাড়ি হলে হওয়া উচিত জলের তলায়। একটা বিরাট ঝিনুকের মধ্যে পুরো মুক্তোর মতো দেখতে, গোল আর সাদা। আর থাকবে একটাই আকাশী-নীল দরজা-কাম- জানলা।
আর খেলতেই যদি হয় তবে দিনরাত এক করে খেলা উচিত, ওই সন্ধ্যেবেলা পড়ার পর ঘড়ি মেপে এক ঘন্টা! এইসব ওর পোষায় না।
এর মধ্যে প্রথম দুটো অসম্ভব হলেও শেষেরটা অবশ্যি সম্ভব। যখন শীতের ও ছুটিতে মামারবাড়ি যায় তখন হামেশাই এই বাড়াবাড়িটা ও করে থাকে। ওর মামার বাড়িতে কাজ করতে আসেন বাসন্তী মাসি। বাসন্তী মাসির বাড়ি হালদার পাড়ায়। ওই পাড়ার বাড়িগুলোও সব মাটির, বইতে যেমন গ্রামবাংলার ছবি থাকে ঠিক সেরকম। ওর মামার বাড়িটা দত্ত পাড়ায়। দত্ত পাড়ার বাড়িগুলো আবার অখাদ্য দেখতে। বদখত রঙ, আবার সাধ করে সব বিশ্রী মতো গ্রিল লাগিয়েছে জানলা দরজায়। তবে মাটির বাড়ির মতো কষ্ট নেই, পোকামাকড় ইঁদুরের উৎপাত কম। নিকোতে টিকোতেও হয় না। স্বপ্না বলেছে। স্বপ্না হল বাসন্তী মাসির মেয়ে, মামার বাড়িতে এলে স্বপ্নাই ওর বেস্ট ফ্রেন্ড। ওরা একসঙ্গে শুকিয়ে যাওয়া খালের গর্তে নেমে নেচে বেড়ায়। সারা গা হাত পায়ে ধুলো লেগে যায়। স্বপ্নাও ওর মতো বেশ বাড়াবাড়ি করতে পারে। নতুন তৈরী একটা লোকনাথ বাবার মন্দিরের সামনে গিয়ে ওরা দুজন মিলে গড় হয়ে মাটিতে প্রণাম করে। তারপর স্বপ্নার দেখাদেখি মিছিমিছি দণ্ডি কাটে। দুজনে মিলে খুব খুউউব জোরে জোরে জয় লোকনাথ বাবা, জয় মা কালী, জয় বাবা ভোলানাথ এইসব যা খুশি বলে বলে মাটিতে গড়াগড়ি খায়। হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যাবার জোগাড়। সবাই অবাক হয়ে দেখে ওদের। আর ও দেখে স্বপ্নার ফ্রকের পেছনটা ছেঁড়া। সেখানে দুটো তিনটে সেফটিপিন লাগানো।
স্বপ্না বলে ও নাকি সব রান্না-বান্না করতে পারে। জল তোলা ঘর মোছা সব করতে পারে। ও প্রথমে একটু চুপ করে থাকে। তারপর বলে স্বপ্নাকে, মিথ্যে কথা বলিস না। তারপর একটু ভেবে বলে, আমিও সব পারি। স্বপ্না পায়ে আলতা পরিয়ে মাঝখানটায় ফুল এঁকে দেয়। বলে, তোমার মামারবাড়ির বাগানের বড় ফুলটা এটা। চন্দ্রমল্লিকা।
স্বপ্নার ইস্কুলে একটা মাত্র ক্লাসরুমে চারটে ক্লাস হয়, ওয়ান টু ফোর। ও ভাবতেও পারে না এটা কিভাবে সম্ভব। সব তো গুলিয়ে যাওয়ার কথা। তাই না মা? মা উত্তরে বলে, বেশি রোদে না ঘুরতে। সারাদিন প্রাইমারি স্কুলের মাঠে কখনও দৌড়ে, কখনও বসে, কখনো ঘাসে গড়াতে গড়াতে ও স্বপ্নাকে কলকাতার গল্প বলে।
কিন্তু আসতে বলে না একবারও। কারণ ও জানে স্বপ্না কখনো আসবে না আর ও নিয়েও আসতে পারবে না। ফেরার দিন ও দেখা করতে পারে না স্বপ্নার সঙ্গে। মাকে বলে স্বপ্নার জন্য দুটো লাল চিপ্সের প্যাকেট কিনে রেখে যেতে। গাড়িতে উঠে ওর মা ফোনে মাসিকে বলে, আমার মেয়ের মন তো খুব নরম, জানিসই তো… ওর মা খেয়াল করে না কথাটা শোনা মাত্র ওর চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে। হাতের মুঠো গোল্লা পাকিয়ে দাঁতে দাঁত চিপে ও জোর করে জানলার দিকে ঠায় তাকিয়ে থাকে সারাটা রাস্তা।