বিগত শতাব্দীর শেষের দিকে ভারতের তুচ্ছ রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় শক্তি, সামরিক ব্যবস্থা, রাজনৈতিক পণ্ডিত, স্থানীয় সহযোগী বা বহিরাগত সাংবাদিক – সবারই বক্তব্য ছিল যে কাশ্মীরের গল্প শেষ হয়ে গেছে, কাশ্মীরের সঙ্ঘর্ষের একটি সুখী উপসংহার রচিত হয়েছে। বেশ কিছু কাল ধরে কাশ্মীর ছিল ভারতের সবচেয়ে বড় আখ্যান, একটি জাতীয় সমস্যা এবং একটি আন্তর্জাতিক নাটকের আঙিনা। উপমহাদেশ ভাগ হওয়ার সাথে কাশ্মীরের এই কাহিনী শুরু হলেও ১৯৮৭ সালের নামমাত্র নির্বাচনের পরবর্তীকালে জঙ্গি সশস্ত্র বিদ্রোহের প্রাদুর্ভাবের মতো আর কোনও ঘটনাই প্রায় কাশ্মীর ভূখণ্ড এবং এর অধিবাসীদের উপর ভারত রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ করেনি। জনপ্রিয় সশস্ত্র আন্দোলনের ফলে পরবর্তী দশকের মধ্যেই প্রায় কাশ্মীরিদের একটি গোটা প্রজন্মকে সমাধিস্থ করতে হয়। বিদ্রোহের বিরুদ্ধে ভারতের প্রতিক্রিয়া ছিল রূঢ় এবং সফল। বিভিন্ন নথি অনুসারে, সশস্ত্র এই সংঘর্ষের ফলে নিহতদের সংখ্যা ছিল ৬০,০০০ থেকে ১০০,০০০ এর মধ্যে। রাষ্ট্রীয় সামরিক ব্যবস্থার অধীনে প্রায়শই হাজার হাজার লোক বাধ্যতামূলকভাবে নিখোঁজ হয়েছিল।
২০০০ সাল থেকে অবশ্য আন্দোলনের একটি নতুন সূচনা হয় বলে ধারণা করা হয়। সশস্ত্র জঙ্গিবাদ চূর্ণ হয়ে যাওয়ার পর মনে করা হচ্ছিল যে ‘কাশ্মীর প্রশ্ন’ এবং সেই লক্ষ্যে যারা লড়াই করছিলেন তাঁরা উভয়েই এখন মৃত এবং সমাহিত। তার জায়গায় গোলাপ এবং তাজা বাতাস, তুষারাবৃত পাহাড় এবং শিকারা বিহার, ডালের ঢেউয়ের উপর অবসর যাপনের নতুন আখ্যান রচিত হচ্ছিল। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে, কাশ্মীরের পরিচিতি একটি স্বর্গীয় পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে নির্মিত হচ্ছিল। শান্তি ফিরে এসেছে এবং তার সাথে এসেছে উন্নয়ন এবং পর্যটন। সত্যি কথা বলতে, এই বিশ্বাস সম্পূর্ণভাবে অযৌক্তিক ছিল না।
রূপরেখা
উত্তর-উপনিবেশিক ভারত রাষ্ট্র প্রস্থানকারী ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে বহু সংখ্যক “জাতীয়তাবাদ” উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে, হায়দ্রাবাদের মতো রাজ্যগুলিকে দখল করে এবং জুনাগড়কে সংযুক্তিতে বাধ্য করে সেই জাতীয়তাবাদগুলির মধ্যে এক ধরনের সংহতিও তৈরি করেছে। দেশভাগের হিংসার পটভূমিতে সামরিক অভিযানের মাধ্যমে কাশ্মীরকে দখল করা হয়েছিল। পলায়নপর স্বৈরাচারী ডোগরা শাসক, যার বিরুদ্ধে কাশ্মীরিরা নিজেরাই ‘কাশ্মীর ছাড়ো’ ব্যানার তুলেছিল, প্রবেশাধিকার দলিল (ইন্সট্রুমেন্ট অফ এক্সেশান) স্বাক্ষরের মাধ্যমে কাশ্মীরের বাস্তবতাকে ভূখণ্ডের ওপর দেগে দিয়েছিল। নাগাল্যান্ড এবং মণিপুর (উভয়ই উল্লেখযোগ্যভাবে অধিক খ্রিস্টান জনসংখ্যা সহ) একইভাবে প্রতিরোধ করার পরেও তাদের ভারতের শাসনের অধীনে আনা হয়েছিল। এই গঠনমূলক আঞ্চলিক একীকরণ মহান বিজয়ী, স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বে অর্জিত হয়েছিল। অথচ যথেষ্ট বিপরীত প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও ভারতের উদারপন্থী শ্রেণীর মধ্যে, এবং আন্তর্জাতিক আঙিনায় নেহরুর পরিচয় আশ্চর্যজনকভাবে একজন মহান শান্তির দূত, তৃতীয় বিশ্বের একজন নীতিবান সমাজতান্ত্রিক নেতা এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী নন-অ্যালাইনমেন্ট আন্দোলনের প্রাথমিক স্থপতি হিসাবে নির্মিত হয়।
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জম্মু ও কাশ্মীরের অধিগ্রহণ এবং খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগাল্যান্ড (এবং মণিপুর)-এর অধিগ্রহণ ছাড়াও, শিখ সংখ্যাগরিষ্ঠ পাঞ্জাব এবং হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ আসামে ভারতের রাষ্ট্রীয় ঐক্যের বিরুদ্ধে প্রকটভাবে অঞ্চলভিত্তিক চ্যালেঞ্জ উত্থাপিত হয়েছিল। জাতিগত আত্মনির্ধারণের জন্য এই বিভিন্ন বিদ্রোহ এবং প্রতিরোধের মধ্যে প্রায় সবকটির উপরেই ভারতীয় রাষ্ট্র নির্দিষ্ট সামরিক পদক্ষেপ হানে, এবং আন্দোলনের যতসামান্য দাবিগুলিকেও খারিজ করে। এই সশস্ত্র আন্দোলনের প্রথম ঢেউ চূড়ান্তভাবে পিষে ফেলার পরে এর পরিবর্তে ভারত রাষ্ট্রের সার্বভৌম কর্তৃত্বের দাবির বিরুদ্ধে একইভাবে তীব্র গণবিদ্রোহ গড়ে ওঠে। উপ-জাতীয়তাবাদের ইতিহাস এবং দ্বৈত-জাতীয়তাবাদ এই বিক্ষিপ্ত আন্দোলনগুলির চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য হলেও, মণিপুর থেকে পাঞ্জাব পর্যন্ত আন্দোলনগুলির ঐতিহাসিক রূপরেখা এখনো তৈরি না হলেও সাম্প্রতিক অতীতের নিরিখে ভারতের জন্য সামরিক বিজয় সত্যিই সিদ্ধান্তমূলক ছিল। কাশ্মীরেও এই একই পাণ্ডুলিপির চেনা ছক অনুসরণ করার কথা ছিল।
একটি বদলে যাওয়া আন্তর্জাতিক পটভূমি এই পরিসরে তার ছাপ রেখে গেছে। ৯/১১-এর পরে, মুসলমানরা বিশ্বব্যাপী ‘অপর’ হয়ে ওঠে, এবং কাশ্মীরেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। রাস্তার ধারে কথোপকথন থেকে সংবাদপত্রের নিবন্ধ পর্যন্ত প্রচলিত সমস্ত চর্চাই স্থানীয় জনসাধারণকে প্রভাবিত করে যে, ‘বিশ্ব সবরকমের হিংসা সহ্য করার ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছে’। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টিতে তাই ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক ভারত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর সশস্ত্র বিদ্রোহ ‘সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন’-এই পর্যবসিত হয়, এবং সহানুভূতি বা অনুশোচনা ছাড়াই চূর্ণ করার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
১৯৯০-এর দশকের প্রথম দিকে সশস্ত্র বিদ্রোহকে চূর্ণ করা এবং ৯/১১ পরবর্তী মুসলিম দুনিয়ার পরিণতি – এই দুই পরিবর্তনের পটভূমিতে এটা বলা ভুল হবে না যে, কাশ্মীরিরা তাদের সংগ্রামের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটি শান্ত সংলাপ এবং গুপ্ত কথোপকথনেই ব্যস্ত থাকে। ২০০০-এর দশকের প্রথম দিকে পুনর্মূল্যায়ন এবং সংস্কারের এই মধ্যবর্তী সময়টিকেই সাধারণ মানুষ এবং ‘বিশেষজ্ঞরা’ কাশ্মীর প্রশ্নের চূড়ান্ত পরিণতি হিসাবে ভুল ভাবে ভাবছিলেন। যাইহোক, এই দশক শেষ হবার আগেই শুধুমাত্র আজাদী, স্বাধীনতার দাবিতে ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয় বিদ্রোহ এবং প্রতিরোধের মুখে ২০০০ সালের তথাকথিত ‘শান্তি’ নিভে গিয়েছিল। গোলাপ এবং বাতাসের নতুন কাশ্মীরের মায়াময় প্রেসক্রিপশন কাশ্মীরিদের এই সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষার নিরাময় করতে ব্যর্থ হয়েছিল। জঙ্গিবাদ-পরবর্তী যুগের এই পূর্বাভাসের ব্যর্থতার পর্যালোচনা করার জন্য আমরা ‘অমরনাথ ভূমির জটিলতা’ দিয়ে শুরু হওয়া কাশ্মীরের প্রতিবাদ এবং বিদ্রোহের শেষ দশকে ফিরি।
তীর্থযাত্রা এবং অবরোধ
কাশ্মীরিরা দীর্ঘদিন ধরেই সন্দিহান ছিল যে, কাশ্মীর প্রশ্নের জন্য ভারতের চূড়ান্ত সমাধান জনসংখ্যাতাত্ত্বিক পরিবর্তন এবং উপনিবেশ স্থাপনের মধ্যবর্তী কোনও রূপই নেবে। ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা, যা ভারতের জম্মু ও কাশ্মীর বহির্ভূত নাগরিকদের সেখানে স্থায়ী বাসিন্দা হওয়া, বা রাজ্যে সম্পত্তি এবং জমির মালিকানা থেকে কার্যকরভাবে বঞ্চিত করার ফলে কাশ্মীরিদের এই অবমাননার হাত থেকে কিছু সুরক্ষা প্রদান করেছিল। ২০০৮ সালের ২৬শে মে স্থানীয় রাজ্য সরকার শ্রী অমরনাথ শ্রাইন বোর্ড (এসএএসবি), কাশ্মীরের অমরনাথ মন্দিরে বার্ষিক হিন্দু তীর্থযাত্রার ব্যবস্থা তত্ত্বাবধানের জন্য সদ্য গঠিত একটি স্বশাসিত সংস্থাকে প্রায় ৯৯ একর জমি বরাদ্দ করে। পরিবেশ সংক্রান্ত উদ্বেগ ছাড়াও, এসএএসবিকে জমি হস্তান্তরের এই ঘটনাকে নিশ্চুপভাবে জনসংখ্যার পরিচিতি পরিবর্তনের মাধ্যমে কাশ্মীরের জাতীয় পরিচয় লঙ্ঘনের প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হয়েছিল। ভূমি হস্তান্তর প্রত্যাহারের দাবিতে যে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল তা দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
স্থায়ীভাবে ভূমি হস্তান্তর প্রত্যাহার করা সত্ত্বেও, তৎকালীন রাজ্য সরকার তার সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায় এবং কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী গোলাম নবী আজাদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। জুনের প্রথম দিকে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নতুন গভর্নর, দিল্লিতে কেন্দ্রীয় সরকারের সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্ত জনাব এস কে সিনহা-কে দেওয়া হয়েছিল। এই ঘটনাকে ৯০-এর দশকের উত্তাল আন্দোলনের সময়ে যখন রাজ্য সরাসরি কেন্দ্র থেকে শাসিত হয়েছিল, তার প্রত্যাবর্তন হিসাবেই দেখা হয়। কাশ্মীরে অস্থিরতা বাড়ার সাথে সাথে, এসএএসবি জমি হস্তান্তরের প্রত্যাহার হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জম্মু প্রদেশে প্রতিবাদ-বিক্ষোভের জন্ম দেয়। এই প্রতিবাদ জমি এসএএসবি-র কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি করে এবং শেষ অবধি জম্মু ভিত্তিক সংগ্রাম সমিতি (আন্দোলনের জন্য সমিতি) দ্বারা কাশ্মীর উপত্যকার ‘অর্থনৈতিক অবরোধ’-এর আহ্বান জানায়।
মুজাফফরাবাদ চলো!
কাশ্মীরের সাথে ভারতকে সংযুক্ত করে একটি সংকীর্ণ পাহাড়ী পথ, যা শুধুমাত্র একটি সরু সুড়ঙ্গের মতো বিস্তৃত, যার মাধ্যমে মানুষের যাতায়াত এবং পণ্য পরিবহন সম্ভব হয়। যেহেতু জম্মু আন্দোলন এই পথ অবরোধ করার আহ্বান জানিয়েছিল, এর অর্থ হয়ে ওঠে যে, কাশ্মীরিরা শীঘ্রই অন্যান্য দ্রব্যের পাশাপাশি খাদ্য এবং তেলের মতো অপরিহার্য পণ্যের মজুত ছাড়াই সাফ হয়ে যেতে পারে। স্বাধীনতাপন্থী নেতৃত্ব “মুজাফফরাবাদ চলো” (পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরের রাজধানী মুজাফফরাবাদের দিকে যাত্রা) আহ্বানের মাধ্যমে এই অবরোধের প্রচেষ্টাকে মোকাবিলা করে। কাশ্মীরব্যাপী মানুষ মুজাফফরাবাদের পদযাত্রায় যোগ দিলে, বিক্ষোভকারীদের আগমনের প্রত্যাশায় মুজাফফরাবাদের অধিবাসীরা নিয়ন্ত্রণরেখা পর্যন্ত মিছিল করে তাঁদের স্বাগত জানাতে।
ভারত মিছিলের ওপর সরাসরি গুলি করে পাল্টা জবাব দেয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গুলিতে ১৫০ জন আহত হন এবং হত্যাকাণ্ডে বিশিষ্ট হুরিয়ত নেতা শেখ আবদুল আজিজ সহ ৭ জন নিহত হয়েছেন। নাগরিক বিদ্রোহের বিরুদ্ধে ভারতের সামরিক প্রতিক্রিয়ায় কয়েকশ’ বিক্ষোভকারী ইতিমধ্যেই নিহত হয়েছেন। কারফিউ আরোপ করা হয়েছে এবং চলাচলের উপর নিষেধাজ্ঞাসহ অন্যান্য ব্যবস্থা আন্দোলনের গতি ভাঙার জন্য জারি করা হয়েছে। কিন্তু ২০০৮ সালে হওয়া সবচেয়ে বড়ো প্রতিবাদ এখনো বাকি ছিল।
স্বাধীনতাপন্থী সমন্বয়ের ডাকা ২২ আগস্টের ঈদ-গাহ মিছিলে আনুমানিক দশ লক্ষ মানুষ যোগ দিয়েছিলেন। প্রায় এক সপ্তাহ পরে নির্ধারিত পরবর্তী মিছিলটি ছিল উপত্যকার বাণিজ্যিক কেন্দ্র এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক এলাকা, নাগরিক সচিবালয়, রাজ্য বিধানসভা, স্থানীয় হাইকোর্ট এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক বিভাগ যেখানে অবস্থিত সেই লাল চকে। ফরাসি বিপ্লবের জন্য বাস্তিলের মতো, অথবা আরব বসন্ত শেষ হওয়ার অনেক আগেই তাহরির স্কোয়ারের মতো ‘লাল চকের পতন’-ও সম্ভাব্য বিপ্লবী ভূমিকা নিতে পারতো। ভারত এই সম্ভাব্য হুমকির প্রতি নির্মমভাবে সাড়া দেয়।
কারফিউ এবং বিধিনিষেধগুলি কয়েক সপ্তাহ ধরে জারি করা হয়, এবং কোনও ধরনের চলাচলের অনুমতি ছিল না। মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, ওষুধ ফুরিয়ে যায়, শিশুরা দুধের জন্য কাঁদতে থাকে। আর কোনো মিছিল ও বিক্ষোভের অনুমতিও ছিল না। কয়েক মাস পরে অবরোধের গতি ভেঙে যায়, বিক্ষোভের তীব্রতা কমে যায় এবং কাশ্মীরকে ‘স্বাভাবিক অবস্থায়’ ফিরিয়ে দেওয়া হয়। ২০০৮ সালের বিক্ষোভের শেষে, ভারতীয় বাহিনীর হাতে প্রায় ৭০ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছিল, হাজার হাজার আহত হয়েছিল, এবং কাশ্মীরিদের একটি নতুন প্রজন্ম বিদ্রোহের চুল্লিতে নিজেদের সেঁকে নিয়েছিল।
২০০৮ সালের বিক্ষোভের ফলে সৃষ্ট আবেগপ্রবণ জনপ্রিয় নাচ-গান-প্রতিবাদের ছবি কাশ্মীরিদের স্মৃতিতে গেঁথে যায়। একটি সম্মিলিত অতি-দৈহিক ছন্দময় আন্দোলনের জন্ম হয়, যেখানে পুরুষ এবং প্রায়শই মহিলারা বৃত্তে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে তড়িঘড়ি করে মাটিতে আঁকা মানচিত্রে বা ভারতের পতাকার ঝাঁপিয়ে পড়ছেন, “রাগদো-রাগদো”-এর সংক্ষিপ্ত স্লোগানে স্পন্দিত হচ্ছে তাঁদের বাহু। এই স্লোগান রূপান্তরকামী প্রতিবাদীদের একটি গোষ্ঠীই প্রথম উজ্জীবিত করে তুলেছিল – “মাড়িয়ে দাও! মাড়িয়ে দাও! ভারতের উপর!” তাদের হাতে ভোট দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি বলে পা দিয়ে দেওয়া এই সংক্ষিপ্ত গণভোট কাশ্মীরিদের কাছে মর্মস্পর্শী স্মৃতি, এবং ২০০৮ সালের শান্তিপূর্ণ গণ বিক্ষোভ এবং প্রতিরোধের একটি দীর্ঘস্থায়ী উত্তরাধিকার।
পাথর এবং গুলি বন্দুক
২০০৯ সালে কাশ্মীর আবারও বিক্ষোভ, কারফিউ, ধর্মঘট এবং হত্যার বৃত্তে জড়িয়ে পড়বে, এবারে শোপিয়ানের ‘দ্বিগুণ-ধর্ষণ’ এবং ‘তিনগুণ-হত্যাকাণ্ড’ মামলার জেরে। ২০০৯ সালের ২৯শে মে নিলোফার (২২) এবং আসিয়া (১৭) – একে অপরের ননদ এবং জা, নিখোঁজ হন এবং পরে স্থানীয়দের মতে, গ্রীষ্মকালে শুকিয়ে যাওয়া পাশের একটি খালে তাঁদের ধর্ষিতা ও মৃতা অবস্থায় পাওয়া যায়। তিনগুণ হত্যার মামলার তৃতীয় শিকার ছিলেন নীলফোরের অনাগত সন্তান, যে তার মায়ের গর্ভেই নিহত হয়েছিল। নিহতের পরিবার ও স্থানীয়দের অভিযোগ, ওই এলাকায় অবস্থিত ভারতীয় সেনারাই এই অপরাধ করেছিল। স্থানীয় সরকার একটি তদন্ত কমিশন প্রতিষ্ঠা করে, যার সিদ্ধান্ত অনুসারে এই দুই মহিলাকে ধর্ষণ ও খুন করা হয়েছিল। কিন্তু এই ফলাফল খুব শীঘ্রই কেন্দ্রীয় সরকারী সংস্থা সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (সিবিআই) কর্তৃক পরিচালিত আরও নানান তদন্তের মাধ্যমে এই সিদ্ধান্তে পরিবর্তিত হয়, যে এই মহিলারা স্রোতের হাঁটু-গভীর জলে ডুবে মৃত। ভারতীয় বিচার ব্যবস্থার প্রতি কাশ্মীরিদের সহজাত অবিশ্বাস আবারও নিশ্চিত হয়ে ওঠে। এঁর পরবর্তীতে প্রতিবাদ এবং কারফিউ-র নিয়মিত চক্র কয়েক মাস ধরে অব্যাহত ছিল, এবং আন্দোলনের দাবি আবার ভারত থেকে আজাদীর জন্য আবেগপূর্ণ আহ্বানে প্রসারিত হয়েছিল।
২০১০ সালের গ্রীষ্মের মধ্যে হওয়া এই আহ্বানগুলি প্রায়শই মুষ্টিবদ্ধ মুঠো থেকে পাথর ছোঁড়া দিয়ে শুরু হয়েছিল। ১১ জুন, বেসামরিক লোকদের একটি সমাবেশ ভারতীয় বাহিনীর সর্বশেষ মোকাবিলার প্রতিবাদ করছিল, তখন সতেরো বছর বয়সী তুফায়েল মাত্তু নিহত হন। সামরিক বাহিনী দাবি করেছিল যে তারা পাকিস্তান থেকে জঙ্গিদের গ্রেপ্তার করেছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, নিহতদের কেউই পাকিস্তানি বা সন্ত্রাসবাদী কোনওটাই ছিলেন না। তুফায়েলের মাথার খুলি স্থানীয় পুলিশের ছোঁড়া টিয়ার গ্যাসের ক্যানিস্টারের আঘাতে উন্মুক্ত হয়ে যায়। এই ধরনের অন্যান্য হত্যাকাণ্ড, হিংস্রতা এবং বর্বরতার চেয়েও তুফায়েলের হত্যা কাশ্মীরিদের অনেক বেশি হতবাক করে দেয়। তুফায়েল, একটি ছোট্ট ছেলে, যে বড় হয়ে উঠতে চলেছিল, কাশ্মীরে ক্ষমাহীন প্রবল বিক্ষোভের এক গ্রীষ্মের সূচনা করে। এই সময়ের সমস্ত ইতিহাস একটি অল্প বয়স্ক, নিরীহ স্কুলছাত্রের অন্যায় হত্যাকাণ্ডের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
২০০৮ সালের শান্তিপূর্ণ গণবিক্ষোভের পর থেকে, ভারতীয় রাজ্য অনুধাবন করতে পেরেছিল যে শান্তিপূর্ণ বিদ্রোহগুলিকে বাড়তে দেওয়া খুব বিপজ্জনক। মিছিল ও রাজনৈতিক সভা নিষিদ্ধ হওয়ায় স্বাধীনতাপন্থী নেতৃত্বকে আটক করা হয় এবং কারফিউ জারি করা হয়, ফলে ‘কানি জং’ (পাথর-যুদ্ধ) একটি প্রতিবাদী প্রতিক্রিয়ার কেন্দ্রীয় ধারায় পরিণত হয়।
বেশিরভাগ যুবক-যুবতী, এবং মাঝেমধ্যে মহিলারাও গলি এবং উপ-গলিতে একত্রিত হয়ে ভারতের সামরিক উপস্থিতি, এলাকার উপর আধিপত্য বিস্তারে নির্মিত প্লাটুন, রাস্তার পাশের সামরিক বাঙ্কার এবং শিবির ইত্যাদি লক্ষ্য করে নিরবচ্ছিন্নভাবে পাথর ছোঁড়া শুরু করে, এবং দাবি জানায় কাশ্মীরিদের হাতে কাশ্মীর ছেড়ে দিয়ে তাঁরা যেন নিজের দেশে ফিরে যান। নাম প্রকাশ না করা, তাদের মুখ ঢেকে রাখার রুমালই ছিল তাদের আত্মরক্ষার একমাত্র মাধ্যম। পর্যাপ্তভাবে উন্নত রাজনৈতিক শক্তির হাতে মানুষের জীবন ও ইতিহাসের অধিকার রক্ষায় অক্ষমতার কারণে পারমাণবিক নিধনও সম্ভাব্য মনে হতে শুরু করে। এর বিরুদ্ধে প্রাগৈতিহাসিক প্রস্তর যুগের মতো খালি হাতে পাথর ছোঁড়াকেই অস্ত্র সম্বল করে কাশ্মীরিরা যুদ্ধ-প্রতিবাদকে প্রায় একটি শিল্প-রূপ হিসাবে গড়ে তোলে। একটি ধূর্ত পারমাণবিক হলোকস্টে গুঁড়িয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে যেন এক সাধারণ পার্থিব অনুভূতির পুনরুদ্ধার।
যখন গ্রীষ্ম শেষ হয়ে গিয়েছিল, এবং কাশ্মীর তার রাগ আর ক্ষোভের শেষ মজুদও শেষ করে ফেলেছিল, তার মধ্যে শতাধিক শিশু নিহত হয়েছিল। ভারতীয় বাহিনী পাথর-যুদ্ধের জবাব দেয় নির্বিচার গোলাবারুদ এবং ক্রমবর্ধমানভাবে বিক্ষোভকারীদের দিকে প্যালেট বন্দুক দিয়ে আঘাত করে। প্যালেট বন্দুকগুলি প্রাণঘাতী না হলেও এগুলি সামরিক বাহিনীকে কম হত্যা করে আরও বেশি আঘাত করতে সাহায্য করে। আজ পর্যন্ত শত শত কাশ্মীরি – প্রতিবাদী এবং অ-প্রতিবাদী, গণ-অন্ধ করার এই অস্ত্রের কাছে তাদের চোখ হারিয়েছে। অন্যরা এই ক্ষতের যন্ত্রণা তাদের মুখ, খুলি, চোয়াল, শিরদাঁড়া, বাহু এবং পায়ে বহন করে।
২০১৬ সালে মূলনিবাসী হিজবুল মুজাহিদিনের তরুণ জঙ্গি কমান্ডার বুরহান ওয়ানির হত্যাকাণ্ড (যিনি তার সামরিক কর্মকাণ্ডের চেয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁর সাহসী উপস্থিতির জন্যই কাশ্মীরিদের কাছে বেশি পরিচিত ছিলেন) কাশ্মীরে আবারও ভারতের দখল বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহের জন্ম দেয়। আবারও, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারী প্রায় শতাধিক বেসামরিক নাগরিক নিহত হন, এবং আবারও বহুসংখ্যক লোক অন্ধ হন, এবং হাজার হাজার মানুষ আহত ও কারারুদ্ধ হন। মাসব্যাপী অবরোধ, কারফিউ, দোরগোড়ায় সৈন্য এবং পিএসএ এবং পেলেট-বন্দুকের আইনী এবং দমনমূলক হিংসার পরিচিত বাস্তবতার মুখে বিক্ষোভগুলি আরও একবার ভেঙে যায়।
দ্বিতীয় সংযোজন
২০০৮ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রতি বছরে শুরু হওয়া প্রতিটা প্রতিরোধের ঢেউ আগের থেকে সাহসী এবং শক্তিশালী হয়েছে। বছরের পর বছর ধরে কাশ্মীরি মানুষ এবং রাষ্ট্র উভয়েই তাদের সরঞ্জামকে নতুন করে সাজিয়েছে এবং নতুনভাবে অভিযোজিত করেছে। কাশ্মীরিরা জীবন ও অঙ্গ হারাতে ইচ্ছুক এবং ভারত হত্যা ও অবমাননা করতে ইচ্ছুক। সমস্ত বিখ্যাত যুদ্ধের মতোই, এটিও একটি অসম যুদ্ধ। মোদির হিন্দুত্ববাদী-জাতীয়তাবাদী বিজেপির বৃদ্ধি এবং বিজয়ের সাথে সাথে ভারতের সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থা ক্রমশই আরও ডানপন্থী হয়েছে। ভারতবর্ষের উদার অংশ এবং ভাবধারার ক্ষয়ক্ষতি কমবেশি সম্পূর্ণ। তবে মোদির মহান অভ্যুত্থান, তার মুকুটের পালক কাশ্মীরের দ্বিতীয় অধিগ্রহণ এখনও বাকি রয়ে গেছে।
৫ আগস্ট, ২০১৯ ভারতের সংসদ একতরফাভাবে, এবং সম্ভবত বে-আইনিভাবে কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসনের শেষ সাক্ষী ৩৭০ ধারা বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয়। তারপর থেকেই রাজ্যটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে; লাদাখ এখন একটি পৃথক সত্তা, জম্মু ও কাশ্মীর বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বারা সরাসরি নিযুক্ত লেফটেন্যান্ট-গভর্নরের কর্তৃত্বাধীন একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পর্যবসিত হয়েছে। জনগণতাত্ত্বিক বদলের আশঙ্কায় ২০০৮ সালে যেসমস্ত বিক্ষোভের সূচনা হয়েছিল সেই আশঙ্কা বাস্তবায়িত হতে শুরু করেছে, কারণ, এখন জম্মু-কাশ্মীরের স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার উপায়গুলি ভারতীয়দের জন্য ব্যাপকভাবে উপলব্ধ, এবং এই প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই চলমান। মোদির কাশ্মীর বিজয় সম্ভবত তাৎপর্যপূর্ণ হওয়ার থেকে বেশি আনুষ্ঠানিক চরিত্রের। সত্যি কথা বলতে, ভারতের কাশ্মীর বিজয়ের বিষয়বস্তু, অন্যান্য অঞ্চলের মতোই দীর্ঘ এবং নিরলস। প্রথম পর্যায়ে অঞ্চল দখলের মতো আদিম আহরণের প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে একটুও জমি না দিয়ে জঙ্গিবাদ নির্মূল করা এবং ব্যাপক বিক্ষোভকে নির্মূল করা, খুন এবং নির্যাতনের সমস্ত প্রক্রিয়াই ভারতের নীলরক্তের ধর্মনিরপেক্ষ-উদারপন্থী শ্রেণির দ্বারা সম্পন্ন করা হয়েছিল। অথচ, কাশ্মীর প্রশ্নের উল্লেখ করলেও, ভারতে মোদির বর্তমান বিরোধীপক্ষ এই শ্রেণির প্রত্যাবর্তনের আকাঙ্ক্ষায় অধীর।
এই যুগ-পরিবর্তক পদক্ষেপ সফলভাবে অর্জন করতে মোদি সরকার কাশ্মীরকে একটি সামরিক ছাউনিতে পরিণত করেছে। তিন মাস ধরে চলমান একটি সামরিক অবরোধ অবিলম্বে চালু করা হয়, যেখানে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং মোবাইল ফোন স্থায়ীভাবে জ্যাম হয়ে যায়। কয়েক মাস পরে তীব্র আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ল্যান্ডলাইন ফোনগুলি অবশেষে চালু করা হয়। এটা অস্পষ্ট যে উপত্যকাকে বুটের নিচে দাবিয়ে রাখার জন্য ঠিক কতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, বা বিভিন্ন সময়ে আটক করা হয়েছিল। কিন্তু সেই সংখ্যা কয়েক হাজার বা তার বেশি হতে বাধ্য। কাশ্মীরের এই চূড়ান্ত অবমাননা নিয়ে কিছু বিক্ষিপ্ত শেষ প্রতিবাদ ছাড়া কোনও বড় বিক্ষোভ হয়নি। এবার সামগ্রিকভাবে কাশ্মীরিরা ধৈর্য্যের পরীক্ষায় রাষ্ট্রকেই টক্কর দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কাশ্মীরের জন্য কোনও আশাবাদী পূর্বাভাস নেই, যদিও তার এই অসম্মত অস্বীকারের মধ্যে এক ধরনের মর্যাদা রয়েছে। বিক্ষোভ থেকে গণ-বিদ্রোহ, ধৈর্য এবং নীরবতা পর্যন্ত সবক্ষেত্রে কাশ্মীর তার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে, কাশ্মীর তার অস্থির হৃদয় ধ্বনিত করছে।
ভাষান্তরঃ জিগীষা ভট্টাচার্য
চিত্রঋণঃ মীর সুহেল, আল জাজিরা