

১৯৪০ সালে প্রকাশিত ডাস্ট বোওল রিফিউজিদের দুর্দশা আর বেঁচে থাকার লড়াই নিয়ে উডি গাথরীর প্রথম আধা–আত্মজীবনীমূলক গানের অ্যালবাম – ‘ডাস্ট বোওল ব্যালাডস্‘-এর গানগুলি যে ধুলো ঝড়ে বিধ্বস্ত, সব হারানো মানুষগুলোর নিজেদের গান হয়ে উঠতে পারল এবং বিশ শতকের আমেরিকার সবচেয়ে ভয়াবহ এক জলবায়ু বিপর্যয়ের আর্থ–সামাজিক এবং রাজনৈতিক অভিঘাতের সঙ্গে এই যে উডি গাথরীর নাম চিরকালের জন্য জুড়ে গেল – তার কারণ বোধহয় এই গানগুলোর আদ্যন্ত সহজ সরল ভাষা আর লৌকিক সুর। এই ভাষা আর সুর আসলে খেটে খাওয়া, কৃষিজীবী মানুষগুলোর একেবারে নিজস্ব। আর যে জিনিসটা এই গানে তারা পেল তা সমস্ত অন্যায়, অবিচার, বঞ্চনা, না–পাওয়া আর অসহায়তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পীড়িত অথচ প্রাণময় মানুষের নিজস্ব রঙ্গরস আর কৌতুকের স্ফুরণ।
‘ডাস্ট বোওল ব্যালাডস্‘-এর প্রথম খণ্ডের প্রথম গান ‘টকিং ডাস্ট বোওল ব্লুজ‘-এ এমনই এক হতভাগ্য কিন্তু রসিক চাষির খবর মেলে যে একসময়ে চাষবাস করে বউ বাচ্চা নিয়ে বেশ ভালই দিন গুজরান করছিল কিন্তু ধুলো ঝড়ের মুখে পড়ে যাকে শেষমেশ চাষের জমির বদলে একটা গাড়ি কিনে বাস্তবের ডাস্ট বোওল থেকে অলীক ‘পীচ বোওলের‘ উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে হয়। প্রথমদিকে সব বেশ ভালই চলছিলো। কিন্তু কিছুদুর গিয়েই পথের এক খাড়া বাঁকে টাল সামলাতে না পেরে সেই লড়ঝড়ে ফোর্ড গাড়ি তার সওয়ারি সমেত উড়ে গিয়ে পড়ে। গাড়ির মতই সেই চাষির সব স্বপ্নও তখন ছত্রখান। রসালো পীচ ফল তো দূরস্ত, শেষে ভুখা চাষিকে এক অপূর্ব পাতলা ঝোলে উদরপূর্তি করতে হয়। সে ঝোল এমনই পাতলা, এতই স্বচ্ছ যে তার তলায় যে কোন ম্যাগাজিন রেখে গড় গড় করে পড়ে ফেলা যায়। শুধু তাই নয়, চাষির মনে হয়, ঝোল যদি আর একটু পাতলা হত তবে দেশের দন্ডমুন্ডের কর্তারাও সেই স্বচ্ছ ঝোলের মধ্যে দিয়ে মানুষের অবস্থা স্পষ্ট দেখতে পেত—
‘And my wife fixed up a tater stew
We poured the kids full of it
Mighty thin stew, though
You could read a magazine right through it
Always have figured
That if it’d been just a little bit thinner
Some of these here senators
Coulda seen through it.’
একেই বোধহয় ইংরেজিতে বলে ‘ব্ল্যাক হিউমর‘ বা ‘গ্যালোস হিউমর‘ – ফাসিঁকাঠে ঝোলার মুহূর্তেও যেন কোন নাছোড়বান্দা কৌতুকে চোখ দুটো চকেচকে আর ঠোঁটের কোণে হাড় জ্বালানি হাসি। এই হাসি একমাত্র তারাই হাসতে জানেন যারা প্রতিনিয়ত মরতে মরতে বাঁচেন আর শুধু বাঁচবেন বলেই লড়াই করেন রোজ। এ রকমই আরেকটি ব্ল্যাক হিউমরের গান ‘Dusty Old Dust (So long, It’s Been Good to Know Yuh)’। এই গানে উডি লিখছেন–
The sweethearts, they sat in the dark and they sparked
They hugged and they kissed in that dusty old dark
They sighed, they cried, they hugged and they kissed
But instead of marriage, they talked like this
Honey, so long, it’s been good to know you
So long, it’s been good to know you
So long, been good to know you
The dusty old dust is a-gettin’ my home
And I got to be driftin’ along…
উডির ব্যঙ্গ রসের আরেকটি সার্থক উদাহরণ ‘Dust Bowl Pneumonia’ যেখানে তিনি সেই সময়কার অতি জনপ্রিয় জিমি রজার্সের ‘ইওডলিং‘ – এর ভঙ্গিকে ঠাট্টা করে গাইছেন –
Now there ought to be some yodelling in this song
There ought to be some yodelling in this song
But I can’t yodel for the rattling in my lung…
এমনকি উডি গাথরীর যে গানগুলির আঙ্গিক তুলনামূলকভাবে সিরিয়াস সেগুলিরও কিন্তু মূল কথা ডাস্ট বোওল রিফিউজিদের চূড়ান্ত জীবনীশক্তি আর বেঁচে থাকার অদম্য জেদ। ‘Dust Can’t Kill Me’ গানটি এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখ্য।


এতো গেল কথার কথা, এবার একটু সুরের কথায় আসা যাক। যে ‘টকিং ব্লুজ‘ আঙ্গিকে উডি তার এই গান বাঁধেন তাতে কিন্তু গানের কথা ‘গাওয়া‘ হয় না, ‘বলা‘ হয়। এ এক ভারি মজার বিষয়। গ্রামীণ গতর–খাটিয়ে মানুষ চিরকাল লৌকিক গানের মধ্যে দিয়ে তাদের আনন্দ–বেদনা, স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গের কথা তো ‘বলেই‘ এসেছেন। এই প্রশ্নে দেশকালের বিভেদও কোথায় যেন লুপ্ত হয়ে যায়। তাই আমেরিকার দক্ষিণ মধ্যভাগের শ্বেতাঙ্গ–কৃষ্ণাঙ্গ লোক শিল্পীরাই শুধু নন, এমনকি এই বাংলার গ্রামাঞ্চলের মানুষের ভাষাতেও গান শুধু ‘গাওয়া‘ হয় না, গান ‘বলা‘ হয়। ‘টকিং ব্লুজ‘ আসলে গ্রামীণ লৌকিক সংগীতের সেই চিরকালীন ধারারই এক শাখা যেখানে এক ছন্দবদ্ধ নাটকীয়তায় কথা বলাটাই প্রধান। সুরের জটিল কৃৎকৌশল সেখানে একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক। উডি গাথরীর হাতেই এই টকিং ব্লুজের জন্ম এরকম একটা ধারণা সাধারণভাবে থাকলেও আসলে কিন্তু প্রথম যে মানুষটির গলায় এই গান বাণিজ্যিকভাবে শোনা যায় তিনি সাউথ ক্যারোলিনার লোকগায়েন ক্রিস্টোফার অ্যালেন বুশিয়ন (Christopher Allen Bouchillon, 1893-1968), যিনি আবার ‘Talking Comedian of the South’ হিসেবেও যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিলেন। ১৯২৭ এ কলম্বিয়া রেকর্ড বুশিয়নের ‘টকিং ব্লুজ‘ গান প্রথম প্রকাশ করে। এর ঠিক পরের বছর ‘টকিং ব্লুজের‘ সিক্যুয়েল হিসেবে প্রকাশ পায় ‘নিউ টকিং ব্লুজ‘। এই নিয়ে বেশ একটা মজার গল্পও শোনা যায়। বুশিয়নের গলার আওয়াজ আর সুর নাকি এতটাই ভয়ঙ্কর ছিল যে রেকর্ডিং ডিরেক্টর গানের থেকে তার কথা বলা শুনতে অনেক বেশি পছন্দ করতেন। সেই কারণেই তিনি বেশ কিছু গান বুশিয়নকে দিয়ে না গাইয়ে শুধু কথা বলার ঢং–এ রেকর্ড করান। অ্যালবামটি প্রকাশ পাওয়ার পর এই গানগুলিই সাড়া ফেলে দেয়। আর অ্যালবামের নাম থেকেই এই ধারার গান গুলির নাম হয় ‘টকিং ব্লুজ‘। কাজেই উডিকে টকিং ব্লুজের জনক তো বলা যায়ইনা, বরং একথাও আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন যে উডি গাথরীর বেশ আগেই এই জাতীয় গান যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। কিন্তু উডি যেটা করলেন তা হলো তিনি মূলত হাস্যরসাত্মক গ্রামীণ সংগীতের এই ধারাকে ১৯৪০–৫০এর দশকের মধ্যে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের এক ভাষ্য করে তুললেন, আর সেটা করলেন গানের একেবারে গভীরের কৌতুক রসটিকে অক্ষুন্ন রেখে। পরবর্তীতে আলমানাক সিঙ্গারসদের হাত ঘুরে বব ডিলানের গানে এই ছাপ স্পষ্ট বোঝা যায়। বুশিয়নের একটি গানের শুরুটা এরকম –
“Well, if you want to get to heaven,
Let me tell you what to do,
Got to grease your feet into little
Mutton stew…”.
এবার আলমানাক সিঙ্গারসের ‘টকিং ইউনিয়ন‘ গানের দিকে একটু তাকানো যাক—
“Now, if you want it higher wages,
let me tell you what to do
You got to talk to the workers in the shop with you…
You got to build you a union,
Got to make it strong
But if you all stick together, boys
It won’t be long…”
—গানের কথা তো বটেই এমনকি সেই কথার ছন্দেও বুশিয়নের প্রভাব কান এড়িয়ে যাবার নয়।


তবে আমেরিকার প্রতিরোধের গানে চিরকালীন লৌকিক সুরের সর্বজনীন আবেদন এবং সেই মর্মে উডি গাথরীর একজন যথার্থ গণগায়েন হয়ে ওঠার গল্প আরো একজন মানুষকে বাদ দিয়ে লেখা সম্ভব নয় – তিনি জোয়েল ইমানুয়েল হেগলুন্ড, আমাদের সব্বার চেনা জো হিল (১৮৭৯–১৯১৫)। সুইডিশ–আমেরিকান এই শ্রমিক নেতাই বোধহয় প্রথম নির্দিষ্টভাবে শ্রমিকদের একজন হয়ে তাদের রাজনৈতিক লড়াইয়ে সংগঠিত করার প্রশ্নে শ্রমিকদের নিজেদের সংস্কৃতি, বিশেষ করে তাদের সংগীতের সঙ্গে একাত্ম হবার গুরুত্ব উপলব্ধি করেন। তিনি এক জায়গায় লেখেনও, “একটা পামফ্লেট, তা যত ভালো করেই লেখা হোক না কেন, একবারের বেশি কেউ পড়ে না। কিন্তু ভালো একটা গান মন দিয়ে শিখলে তা বারবার গাওয়া যায়। আমি বিশ্বাস করি, কেউ যদি খুব সাদামাটা সত্যি কথাগুলো দিয়েই একটা সরস গান বাঁধতে পারেন তবে অনেক বেশি সংখ্যক শ্রমিকের কাছে তিনি তার বক্তব্য পৌঁছে দিতে পারবেন…”।1 ১৯১৫ সালে মিথ্যে মামলায় ফাঁসিয়ে ফায়ারিং স্কোয়াডে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মেরে ফেলার আগে পর্যন্ত জো হিল তাই শুধু মিটিং–মিছিল করেই শ্রমিকদের সংগঠিত করার চেষ্টা করেননি, তিনি তাদের কাছে তার রাজনৈতিক বক্তব্যকে আরো গ্রহণযোগ্য করে তুলতে সহজ সরল কিন্তু রসোত্তীর্ণ গানও বেঁধেছেন। এই গানগুলির মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় সম্ভবত ‘The Preacher and the Salve’। এই গানেই আমরা প্রথম তার সেই বিখ্যাত উক্তি ‘pie in the sky’-এর সঙ্গে পরিচিত হই, গোদা বাংলায় যার মানে একবার মরলেই ‘সব দুঃখ হরিপালে‘। ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স অফ দা ওয়ার্ল্ড সংগঠনের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে জো হিলের এইসব গান ‘দ্য লিটল রেড সং বুক‘ বা ‘দ্য ওবলি সং বুক‘-এর একেবারে প্রথম সংস্করণেই জায়গা করে নেয়। সম্ভবত ১৯৩০এর দশকের শেষের দিকে এই ‘লিটল রেড সং বুক‘ উডির হাতে আসে।2 তিনি নিশ্চয় শ্রমজীবী মানুষের গান সম্পর্কে জো হিলের অবস্থানের গুরুত্ব ও সত্যতা অনুভব করতে পেরেছিলেন। জো হিল যে আরও অনেকের মতো উডিরও অনুপ্রেরণা ছিলেন ‘জো হিল‘ গানটিই তার প্রমাণ। তাই উডিও যে জনপ্রিয় সব লোকগান, ব্যালাডস্, প্রচলিত ধর্ম স্তোত্রের কথা ও সুর ব্যবহার করে, তাদের ভেঙে গড়ে, কখনো বা প্যারোডি করে তার নিজস্ব রাজনৈতিক চেতনায় জারিয়ে মানুষকে উপহার দেবেন তাতে আশ্চর্য কি! আর এই কাজ বোধহয় একমাত্র তার পক্ষেই এমনভাবে করা সম্ভব ছিল। সম্ভব ছিল কারণ উডি একদিকে যেমন ছিলেন লোকগান, ব্যালাডস, ব্লুজ, কান্ট্রি ও পার্লার সং এবং খ্রিস্টীয় সব স্তোত্রের এক চলমান এনসাইক্লোপিডিয়া, অন্যদিকে তেমনি ছিলেন একনিষ্ঠ পাঠক। পাম্পা, টেক্সাস বা অন্য যেকোনো জায়গার পাবলিক লাইব্রেরী গুলিতে যখন যা বই হাতের কাছে পেয়েছেন পড়ে ফেলেছেন। তদুপরি যুক্ত হয় এক তীব্র সমকাল সচেতনতা আর লড়াকু মানুষের অপার সম্ভাবনার প্রতি এক গভীর আস্থা।
দ্য গ্রেট ডাস্ট স্টর্ম গানটিতে তাই বিধ্বংসী ঝড়ের কথা যেমন আছে তেমনি আছে সেই ধুলোঝড়ে ধস্ত মানুষের অদম্য প্রাণশক্তির কথা। এ গানের শেষ লাইন–
We rattled down that highway to never come back again…
ঝড়ে সব গেছে, তবু প্রাণটা তো এখনো আছে। ফেরার মত আর কোন ঠাই নেই বটে, কিন্তু সামনে চলার পথ তো রয়েছে। আর এই পথ ধরেই সব হারানো মানুষেরা পৌঁছে যাবে ক্যালিফোর্নিয়ার স্বপ্নরাজ্যে, যেখানে ‘the water tastes like wine’ আর ‘the dust storms never blow…’। তাই সেখানে ‘…I ain’t a-gonna be treated this way…’। তা ধুলোঝড়ে ঠাঁইনাড়া মানুষের দল ক্যালিফোর্নিয়ায় পৌঁছে কী পেল? উডি এই উদ্বাস্তুদের প্রতি ক্যালিফোর্নিয়ার মানুষের সীমাহীন বৈরিতা, ঘৃণা আর অবজ্ঞা দেখে তার হতাশার কথা বলতে গিয়ে বলেন, “ক্যালিফোর্নিয়ার এত ফল, এত পীচ, এত সব বাছাই করা অ্যাপ্রিকট, আঙ্গুর এইসব সংগ্রহ করতে অনেক অনেক লোক দরকার। এখানকার লোকেরা নিজেরা তা স্বীকারও করেছে। অথচ এই এরাই অন্য রাজ্য থেকে আসা যে মানুষগুলো এই কাজ সানন্দে করতে চেয়েছিল তাদের কী চূড়ান্ত হেয় করলো।“3 ১৯৩৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লস এঞ্জেলেসের পুলিশ প্রধান জেমস ই ডেভিস ডাস্ট বোওল ও অর্থনৈতিক মন্দায় নিঃস্ব, উদ্বাস্তু মানুষের ঢল আটকাতে জারি করেন ‘বাম ব্লকেড‘। উডি নিজে অবশ্য এই অমানবিক অবরোধ উঠে যাবার পরই লস এঞ্জেলেস এসেছিলেন তবুও তিনি নিজের চোখে এখানকার পুলিশকর্মীদের যে দুর্নীতি দেখেছেন তার কতকটা আভাস মেলে – ‘If you ain’t got thee (Do Re Mi)’ – গানে। এই গানে আমরা দেখি ভিন রাজ্য থেকে আসা যে পরিযায়ী মানুষ যত মোটা টাকা ঘুষ দিতে পারবে তার ক্যালিফোর্নিয়া স্বর্গরাজ্যে প্রবেশের সুযোগ তত বেশি। আইনি পরিসরের বাইরেও উদ্বাস্তু মানুষ ক্যালিফোর্নিয়ায় যেকোনো ধরনের বামপন্থী ও শ্রমিক সাংগঠনিক কাজ কর্মের বিরোধী এক ধরনের সেঘোষিত ‘প্রহরী দলের‘ হাতে মাঝে মাঝেই প্রবল হেনস্থার শিকার হতেন। উডি ব্যক্তিগতভাবেও অন্তত একবার এই ধরনের একটি দলের হাতে পড়েন। তার সেই অভিজ্ঞতার কথা আমরা জানতে পারি ‘The Vigilante Man’ গান থেকে।
এখানে একটা কথা মনে রাখা দরকার, ব্যক্তি উডি নিজে ব্যাপকতর অর্থে একজন ডাস্ট বোওল রিফিউজি হলেও তাকে ঠিক মাইগ্র্যান্ট ক্যাম্পের উদ্বাস্তুদের সঙ্গে এক করে দেখা ঠিক নয়। উডি গাথরীর কাছেও ক্যালিফোর্নিয়া নিশ্চয়ই কোন নিখাদ স্বর্গরাজ্য ছিল না। তবে ক্যালিফোর্নিয়া যে তাকে নিরন্তর নরক যন্ত্রণা ভোগ করিয়েছে এমনটাও নয়। ১৯৩৬ সালেই উডি কাজের সন্ধানে আরো অনেক কপর্দকশূন্য উদ্বাস্তুদের সঙ্গে ক্যালিফোর্নিয়ার পথে পাড়ি দেন। ক্যালিফোর্নিয়ায় পৌঁছানোর পরপরই ১৯৩৭ এ উডি ও তার খুড়তুতো ভাই জ্যাক, লস এঞ্জেলেসের কে এফ ভি ডি রেডিওতে একটি নিয়মিত শো জোগাড় করে ফেলেন। কিছুদিন পরেই এদের সাথে যুক্ত হন ম্যাক্সিন ‘লেফটি লউ‘ ক্রিসমন। এদের যৌথ অনুষ্ঠান – ‘the Woody and Lefty Lou Show’ পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়তা পায় এবং এই অনুষ্ঠানের যৌথ সঞ্চালক হিসেবে উডির বেশ একটা নিজস্ব পরিচিতি গড়ে ওঠে। এফ ভি ডি রেডিওতে উডির রেডিও ম্যানেজার জে ফ্রাঙ্ক বার্ক একটি খবরের কাগজও সম্পাদনা করতেন। তিনি বছর খানেকের মধ্যেই উডিকে তার কাগজের জন্য ক্যালিফোর্নিয়ার মাইগ্রেশন ক্যাম্পের ডাস্ট বোওল রিফিউজিদের অবস্থা নিয়ে প্রতিবেদন লিখতে বলেন। এই প্রতিবেদন লেখার কারণেই উডি এই সময় বিভিন্ন মাইগ্রেশন ক্যাম্পগুলিতে টানা পাঁচ মাস থাকেন। ডাস্ট বোওল রিফিউজিদের ক্যাম্পের জীবন কেমন উডি এই সময়ে তা একেবারে স্বচক্ষে দেখেন। তাকে সংখ্যাগরিষ্ঠ রিফিউজিদের মত ক্যাম্পের অমানবিক হতভাগ্য পরিস্থিতির প্রত্যক্ষ শিকার হতে হয়নি ঠিকই কিন্তু এই রিফিউজিদের সাথে তার একাত্মতা অস্বীকার করার জো নেই। তাই উডি সম্পর্কে মোজেস অ্যাশের মূল্যায়ন – “If you listen to those library of Congress recordings you can hear all the put on he wanted to give Alan Lomax. Dresses the actor acting out the role of the folk singer from Oklahoma”4 – যেমন বাড়াবাড়ি রকমের একপেশে, তেমনি আবার তার গান গুলির উত্তম পুরুষটিকে আক্ষরিক অর্থে এদের স্রষ্টার সঙ্গে এক করে দেখারও বিপদ রয়েছে। তবে একথা মানতেই হবে, ক্যালিফোর্নিয়ায় উদ্বাস্তু সংকটের চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা উডিকে বৃহত্তর নানা সমস্যা, সংঘাত ও বামপন্থী রাজনীতির নানা দিক সম্পর্কে আরো গভীরভাবে সংবেদনশীল করে তোলে। তার কাছে ‘রিফিউজি‘ এই শব্দটি এক ব্যাপকতার রাজনৈতিক দ্যোতনা নিয়ে আসে যার ফলে তিনি ডাস্ট বোওল পরিযায়ীদের সমস্যাকে অন্যান্য নিপীড়িত জনগোষ্ঠির সমস্যার সঙ্গে যুক্ত করে আরো বিস্তৃত এক প্রেক্ষিত থেকে দেখতে পারেন। ১৯৪০ সালে লেখা উডির সবচেয়ে জনপ্রিয় গান – ‘This land is your land’ এও তাই এমন সব লাইন লেখেন –
As I went walking I saw a sign there
And on the sign it said “No Trespassing.”
But on the other side it didn’t say nothing,
That side was made for you and me.5 মার্কিনী গণতন্ত্রের অন্তর্নিহিত অসাম্য আর হিংসার এমন তির্যক অভিব্যক্তি নাহলে সম্ভব ছিল না। উডি নিজে যখন বলেন, “I seen things out there that I wouldn’t believe”6 তখন কিন্তু আমাদের মাথায় রাখতে হবে এই দেখা একাধারে একজন সংবেদনশীল মানুষ, একজন গণগায়েন এবং এক ভিসুয়াল আর্টিস্টের দেখা, যার রাজনীতি তার শৈল্পিক চর্চা ও যাপনের সঙ্গে ওতপ্রোত।
এইসময় নাগাদই এড রবিনের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রে উডির সঙ্গে আমেরিকার কমিউনিস্ট পার্টির দৈনিক পত্র পিপলস ওয়ার্ল্ড এর সম্পাদক রিচমন্ডের একটা যোগাযোগ তৈরি হয়। কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ ক্রমশ নিবিড় হতে থাকে এবং উডি গাথরী বিভিন্ন প্রগতিশীল শ্রমিক মঞ্চে তো বটেই পার্টির অনুষ্ঠানেও গান গাইতে শুরু করেন। পিপলস ওয়ার্ল্ডে উডির ‘উডি সেজ‘ নামে একটি কলাম লেখাও শুরু করেন। সে বছরই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আবহে হিটলার–স্টালিন প্যাক্টকে ঘিরে ফ্রাঙ্ক বার্ক সাহেবের সঙ্গে মতপার্থক্যের জেরে কে এফ ভি ডি রেডিওর শো উডির হাতছাড়া হয়। চাকরি খুইয়ে অভিনেতা ও সমাজকর্মী উইল গিয়ারের পরামর্শে উডি গাথরী ১৯৪০ সালে নিউইয়র্ক শহরে চলে আসেন। নিউইয়র্ক শহরে উডির জীবনের নতুন নতুন দিগন্ত খুলে গেলেও তাতে তার আর্থিক অবস্থার বিশেষ উন্নতি হয় না। ১৯৪১ এ উডি গাথরী আবার সপরিবারে লস এঞ্জেলেসে ফিরে আসেন। সেখানেও তথৈবচ। পুরনো কাজের জায়গা কে এফ ভি ডি রেডিওতে অল্প কিছুদিনের জন্য আবার শো করার অনুমতি পেলেও তার জন্য কোন টাকা উডি পেলেন না। পরিবার নিয়ে প্রায় তিন মাস চূড়ান্ত দারিদ্র্যের মধ্যে কাটানোর পরে হঠাৎই সেই অ্যালেন লোমাক্সের সূত্রেই বনভিল পাওয়ার অথরিটির একটা দারুন কাজ উডি পান। কুলি নদীর উপর বিরাট এক বাঁধ তৈরি হবে। উডি গাথরীকে এই অতি মানবিক প্রকল্পের সাক্ষী হয়ে এর উদ্দেশ্যে গান বাঁধতে হবে। উডিও চললেন ওয়াশিংটন যেখানে ‘on the heels of the unemployed came the victims of the Dust Bowl’ 7।
[ চলবে ]
গানের লিংক:
১) https://youtu.be/aPrnbGm7jas
২) https://youtu.be/C13JFv4JfH8
4) https://youtu.be/-JE3jt4FIFs
6) https://youtu.be/LUNjljx_bhE
7) https://youtu.be/IlaqPRCuRhU
চিত্রঋণ: discogs.com, nydailynews.com, grammy.com, Woody Guthrie Archives.